Skip to main content

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতী আমিনী : আস্থা ও দ্রোহের মিনার

শরীফ মুহাম্মদ

তিনি হঠাত্ করেই চলে গেলেন। হ্যাঁ, সবাইকে হতবুদ্ধি, নির্বাক ও শোকবিদ্ধ করে চলে গেলেন। যেন ঘরবাড়ি-ময়দান শূন্য করেই চলে গেলেন? ঝড়ের রাতে জাহাজ থেকে নাবিক নেমে গেলে যেমন হয়, গহীন অরণ্যে কাফেলা প্রধান নিখোঁজ হয়ে গেলে যেমন হয় দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ও আলেম সমাজের অবস্থা তার চলে যাওয়ায় তেমনই হয়েছে। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী।

মুফতি আমিনী কে ছিলেন? একজন প্রজ্ঞাবান, বড় আলেম ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী দুটি বড় মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে সরব একজন ইসলামী রাজনীতিক ছিলেন। তার পরিচয় এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গত দুই যুগ ধরে তিনি ছিলেন এদেশের ধর্মপ্রাণ-দেশপ্রেমিক মানুষ ও সর্বস্তরের আলেম সমাজের একজন প্রধান প্রতিনিধি। তিনি তাদের ভাই ছিলেন। তিনি তাদের দুঃখ ও দ্রোহের কণ্ঠ ছিলেন। তিনি তাদের নেতা ও অভিভাবক ছিলেন। সঙ্কটকালে তার গমগমা কণ্ঠে আর হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তারা। আহা! এত সুন্দর করে জনসভা ও মাহফিলগুলোতে ইসলামের অতীত গৌরব, বীরত্ব, আশাব্যঞ্জকতা, উদ্দীপনা, আল্লাহনির্ভরতা আর সাহসের পঙক্তিমালা তিনি উচ্চারণ করতেন যে মুহূর্তের মধ্যেই লাখো মানুষের ছায়াচ্ছন্ন, চিন্তাক্লিষ্ট চেহারায় প্রত্যয় ও আশ্বাসের রোদ হেসে উঠত। তিনি তার বক্তব্যে কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা পেশ করতেন। তিনি বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, গাজী নুরুদ্দীন জঙ্গির অমিত সাহসের ইতিহাস উচ্চারণ করতেন। তিনি ইকবাল, হালী, জিগার মুরাদাবাদী ও খাজা আজিজুল হাসান মজযুবের শের আবৃত্তি করতেন। তার কণ্ঠের উঠানামায় লাখো মানুষের মজমা তরঙ্গের মতো দুলতে থাকতো।

আশির দশকের শুরু পর্যন্ত তিনি ছিলেন অতি মনোযোগী ও নীরবতাবাদী একজন মেধাবী আলেম-শিক্ষক। তার শিক্ষক ও অভিভাবক হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) তাকে রাজনীতিতে নামালেন। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সেই যে নামলেন তিনি, আর সরে গেলেন না। তিনি যখন গেলেন তখন কোটি মানুষকে রাস্তায় রেখেই তিনি একদম চলে গেলেন।
নব্বই দশকের শুরুতে ভারতের উত্তর প্রদেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হলে এই দেশে লংমার্চের ডাক দেয়া হয়। সেই লংমার্চ আন্দোলনের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ও প্রধান নির্বাহী ছিলেন মুফতি আমিনী। তার শিক্ষক শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) ছিলেন এ লংমার্চের আহ্বায়ক ও অভিভাবক। মুফতি আমিনী ছিলেন এর কার্যনির্বাহী প্রধান। ১৯৯৪ সালে এক নাস্তিক মহিলা লেখক পবিত্র কোরআন পরিবর্তনের ডাক দিলে তিনি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সারা দেশে ছুটে বেড়িয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেন। হরতাল পালন করেন। সেই মুরতাদ মহিলা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০০১ সালে সব রকম ফতোয়া নিষিদ্ধ করার একটি রায় উচ্চ আদালত থেকে ঘোষিত হলে তিনি বিচারপতিকে মুরতাদ ঘোষণা করে ঝুঁকিপূর্ণ ও ঘটনাবহুল এক আন্দোলনে নেমে পড়েন। তখন চার মাসের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। এই প্রতিটি আন্দোলনেই তিনি ছিলেন মূল আহ্বায়ক এবং আগাগোড়া অনমনীয় ও দৃঢ়পদ। সারাদেশের শীর্ষ আলেমরা প্রতিটি আন্দোলনে তার সঙ্গে ও পাশে থেকে তাকে সহযোগিতা করেন। প্রতিবাদ, আন্দোলন, সংগ্রামে ধর্মপ্রাণ মানুষের আস্থা ও আশ্বাসের মিনারে পরিণত হন তিনি।
আন্দোলন-সংগ্রামে প্রবীণত্ব ও নেতৃত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি সব সময় সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন ছিলেন না। কিন্তু কার্যনির্বাহী দায়িত্ব তাকেই আঞ্জাম দিতে হয়েছে সব সময়। তার সময়ে প্রায় সময়ই তিনি তার গুরুজনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ স্নেহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন। খতিব উবায়দুল হক (রহ.), বি-বাড়িয়ার বড়হুজুর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (রহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) ও আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মতো বটবৃক্ষরা সব সময় তাকে স্নেহ ও ছায়া বিলিয়ে এসেছেন। বড়দের সঙ্গে তিনি এভাবেই শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
মুফতি আমিনী মেধাবী ও সংগ্রামী একজন আলেম ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণের কারণে তার আচরণে অনেক সময় একটা ক্যাজুয়াল ভাব বিরাজ করত। খোলামেলা ভাষায় বক্তব্য দিতেন। জোরের সঙ্গে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। বয়ানের মধ্যেও হেসে উঠতেন। যা দেখলে অনেক সময় তাকে গভীর মনের ও চিন্তার মানুষ বলে মনে হতো না। কিন্তু যারা জানেন তারা জানেন যে, তিনি কেবল হাদিসের দরসের প্রস্তুতির জন্য নয়, একজন অধ্যয়ন পাগল একজন মানুষ ছিলেন। গভীর অধ্যয়ন ও পাঠনিমগ্নতায় তিনি অনেক সময়ই বিভোর থাকতেন। প্রায় প্রতি বছর ইসলামী জ্ঞান, দর্শন, ফিকহ ও চিন্তাধারা বিষয়ে নতুন প্রকাশিত আরবি-উর্দু-ফার্সির বহু কিতাব কার্টন ধরে ধরে তিনি কিনে আনতেন। ইসলাম বিষয়ে আলোচিত নতুন প্রকাশিত কোনো গ্রন্থ তার অপঠিত থাকত না। লালবাগ মাদরাসার বিশাল লাইব্রেরির প্রাঙ্গণে শত শত কিতাবের কোনো কোনো পৃষ্ঠায় কাঠপেন্সিলে তার নোট ও পর্যবেক্ষণ আঁকা আছে।
যারা জানেন তারা মুফতি আমিনীর আরেকটি বিষয় সম্পর্কেও জানেন। এসব কথা কখনও বাইরে প্রচার করা হতো না। বছরের প্রায় প্রতি রাতে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাগলের মতো কেঁদে-কেটে দোয়া করতেন। এ দোয়া কখনও মাদরাসায় তার রুম বন্ধ করে করতেন, কখনও ছাত্রদের ডেকে এনে দফতরে সম্মিলিতভাবে করতেন। দোয়ার সময় দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকতেন। সে কান্না সহজে শেষ হতো না। লালবাগ মাদরাসায় প্রতি বৃহস্পতিবার শেষ রাতে তিনি একটি সম্মিলিত দোয়ার আয়োজন করতেন। রাত ৩টার আগেই সারা মাদরাসার ছাত্ররা উঠে এসে শাহি মসজিদের বারান্দায় তাহাজ্জুদ পড়ত। তেলাওয়াত করত। ফজরের আজানের আধা ঘণ্টা আগে তিনি সবার মুখোমুখি দাঁড়াতেন। এরপর সবাইকে নিয়ে দুহাত আল্লাহর দরবারে তুলে ধরতেন। সামনে ছাত্ররা বসা। উল্টোদিকে একা তিনি দাঁড়ানো। মসজিদের বাতিগুলো থাকত নেভানো। রাজনীতির ময়দানে হুঙ্কার দেয়া মুফতি আমিনী সেই অন্ধকার শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে অসহায়ের মতো, ভিক্ষুকের মতো চিত্কার করে কাঁদতে থাকতেন। তার সঙ্গে সারাটা মসজিদ যেন কাঁদতে থাকত। মনে হতো তার বুক যেন ফেটে যাচ্ছে। কান্নায়-কষ্টে, আবেদনে-আবদারে, দুঃখে-কাতরতায় তিনি নুয়ে নুয়ে পড়তেন। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে এসব দোয়ায় তিনি দেশ, দেশের মানুষ, দেশের স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য বড় একটি সময় জোরে জোরে দোয়া করতেন।
দীর্ঘ একুশ মাস গৃহবন্দী থেকে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। কাছের মানুষরা জানেন, তাকে কতটা চাপের মধ্যে রাখা হয়েছিল। কতবার তাকে আদালতের বারান্দায় টেনে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো একটি মামলা কি তার ব্যক্তিগত দুর্নীতি, উপার্জন কিংবা অনৈতিকতা নিয়ে ছিল? দেশ ও ইসলামের জন্য লড়তে লড়তে, কোরআন ও সুন্নাহর জন্য বলতে বলতে তিনি অবরুদ্ধ হলেন। বছরের পর বছর অবরুদ্ধ ও প্রায় নির্বাক থাকতে বাধ্য হলেন। আমার মতো তার হাজার হাজার অকৃতজ্ঞ ছাত্র, লাখ লাখ আলেম আর কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ তাকে মুক্ত করার কোনো চেষ্টা করিনি। তিনি তো আমাদের হয়েই লড়েছিলেন। তিনি তো দ্বীনের জন্যই টার্গেট হয়েছিলেন। আহা! ক্ষমাহীন নিস্পৃহা ও নির্বিকারত্ব নিয়ে আমরা তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে রাখলাম। কোনো প্রতিবাদ, কোনো আন্দোলন, কোনো শব্দ আমরা করলাম না। এমনকি চিত্কার করে কাঁদলামও না। আমাদের এ অপরাধ কি আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন?
মুফতি আমিনী। আমার শিক্ষক। আমাদের শিক্ষক। আমরা তার জন্য বেহেশতের উঁচু মাকামের প্রার্থনা করি। জানাজার লাখো মানুষের জনসমুদ্র তার জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছেন, ডুকরে ডুকরে কেঁদেছেন, আর ঘন ঘন চোখ মুছেছেন হাজার হাজার মানুষ। তাকে হারানোর কষ্ট অনেকের চোখে গ্রোত সৃষ্টি করেছে। শেষ জীবনে তাকে কষ্ট দেয়ার কষ্টে অনেকের বুকে পাথর জমেছে।
ইয়া আল্লাহ! তোমার প্রিয় এই মর্দেমুমিন ও মর্দে মুজাহিদকে তুমি শান্তির ছায়ায় টেনে নাও। আমিন।

লেখক- কলামিস্ট ও সাংবাদিক

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।