Skip to main content

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না!

-ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী


এক.
মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
বুঝি নি, এতো তাড়াতাড়ি ..
এতো অসময়ে ..
এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ঘুম-কাতুরে না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে, ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি; অনেক মিসকল। সাথে একটা মোবাইলবার্তাÑ মুফতি আমিনী আর নেই! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো এতিম মনটা!
তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা,
এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!
এ শোক একজন শ্রেষ্ঠ আলেমে রাব্বানী হারানোর শোক!
এ শোক একজন শ্রেষ্ঠ হাদীস-বিশারদ মুহাদ্দিস হারানোর শোক!
এ শোক একজন সময়-সচেতন মদীনার রাজনীতিবিদ হারানোর শোক!
এ শোক একজন শ্রেষ্ঠ ফকীহ হারানোর শোক!
এ শোক ইলমে ওহীর একজন প্রাজ্ঞ সেবক হারানোর শোক!
এ শোক দ্বিধাবিভক্ত অদূরদর্শী ইসলামী রাজনীতিবিদদের একজন হিতাকাঙ্খী অভিভাবক হারানোর শোক!
এ শোক একজন শ্রেষ্ঠ আকাবির-প্রেমিক, মুসলিম সভ্যতা ও ইসলামের সোনালী ইতিহাসের উচ্চারণকারী হৃদয়স্পর্শী বক্তার মহাপ্রস্থানের শোক!
এ শোক অনেক বড় শোক!
এ শোক অনেক অশ্রময় শোক!
হে আল্লাহ! আমাদের এ-শোককে শক্তিতে পরিণত করো!



দুই.
আমরা এখন এতিম, এতিমই!
তাঁর মতো এমন অভিভাবক কোথায় পাবো আর?
উম্মাহর দুর্দিনের এমন প্রাজ্ঞ কান্ডারী কোথায় পাবো আর?
সত্যের মহিমায় ভাস্বর এমন ভাঙা কণ্ঠের নির্ভীক সত্য উচ্চারণ কোথায় শুনবো আর?
না, তাঁর ভাঙা স্বরের সোনাঝরা লহরী আর কখনো আমাদের নিষ্প্রাণ বিবেকের পর্দায় দোল দেবে না!
মনে-প্রাাণে জাগাবে না চেতনার বিপুল আলোড়ন!
তাঁর কুরআনের তিলাওয়াত কিংবা হাদীসের উচ্চারণ অথবা খাজা ছাহেবের কবিতার নান্দনিক আবৃত্তি আর কখনো আমাদের চোখে-মুখে আনন্দ-অশ্রর ঝিলিমিলি সৃষ্টি করবে না!
না, কোনোদিন না!
আমিনী-কণ্ঠ এখন চিরস্তব্ধ! চিরনির্বাক!! 
তাঁর মিষ্টি হাসির প্রাণময় কোমল সম্বোধন এখন শুধুই স্মৃতি!
লালবাগ মাদরাসার দফতরের পাশের ঐ কামরাটার দিকে, শ্রদ্ধামেশানো ভালোবাসা নিয়ে এখন কি আর আগের মতো তাকানো যাবে ছলোছলো চোখের ভেজা-ভেজা দৃষ্টি ছাড়া? ঐ কামরার ভিতরে-যে আরেকটা কামরা আছে, সেখানে কি আর বাতি জ্বলবে গভীর রাতে? তন্ময়চিত্ত গভীর মুতালার নিরবচ্ছিন্ন প্রহরে আর কি উদ্ঘাটিত হবে জানার নতুন নতুন বিস্ময়কর দিগন্ত? কিংবা তাঁর আহাজারি-রোনাযারির করুণ বিলাপ কি আর তার দেয়ালে-দেয়ালে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে? কান পাতলে আর কি শোনা যাবে তাঁর আরশ-দোলানো ব্যাকুল মুনাজাতের অশ্রময় চীৎকারময় আকুতির বাঁধভাঙা স্রোতোচ্ছ্বাস? বৃহস্পতিবার শেষ রাতে, শত শত ছাত্রকে নিয়ে শাহী মসজিদের বারান্দায় তিনি আল্লাহর সকাশে যেভাবে হাজির হতেন মহাভিখারির বিনয়-কাতরতা ও আশেকে ইলাহীর অশ্রভেজা সওগাত নিয়ে- তার কোনো নজীর কি আর দেখা যাবে?
আহা! কী কষ্ট, কেমন আমিনীকে হারালাম আমরা?

তিন.
আমার সৌভাগ্য; আমি তাঁর কাছে কিছুদিন হাদীস পড়তে পেরেছি। আমি আমার সীমিত বুদ্ধির ক্ষুদ্র গন্ডিতে বসে দেখেছি এ-ময়দানে তাঁর গভীরতার ব্যাপকতা। হাসতে হাসতে তিনি অবলীলায় বলে যেতেন হাদীসে নববীর নিগূঢ়তম রহস্য ও তাৎপর্যময় ব্যাখ্যা! বিমুগ্ধ ছাত্ররা চোখে-মুখে শ্রদ্ধার লাল-সাদা গোলাপ ফুটিয়ে তাকিয়ে থাকতো তাঁর হাদীস-প্রেম-দ্যুতিত হাস্যোজ্জ্বল চেহারার দিকে!
ছাত্রদের সামনে যখন ইসলাহী ও তারবিয়তী বয়ান পেশ করতেন তখন মনে হতো তাসাওউফের এক ইমাম তিনি- ফিরে এসেছেন যেনো থানভী-গাঙ্গূহী!
খাজা আযিযুল হাসান মাজযূব রহ.-এর কবিতা যখন বলতেন তিনি নিজের ভাঙা-ভাঙা গলার কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে, তখন মনে হতো ভাসছেন তিনি তাসাওউফের প্রেম-সাগরে!
যখন রাজনৈতিক সমাবেশে তাঁর নাম ঘোষিত হতো, তখন হাজার জনতার মন আবেগে-উত্তেজনায় দুলে-দুলে উঠতো! তাদের উৎসুক দৃষ্টি অনিমেষ লেগে থাকতো মঞ্চে, ডায়াসে! আমিনীর উদয়নের পথে! সমাবেশ জুড়ে প্রথমে নেমে আসতো একটা সুনসান নীরবতা! তারপর বক্তৃতা শুরু হলে সেই নীরবতা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো, মুহূর্তেই! নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে সমাবেশস্থল অগ্নিময় হয়ে উঠতো! না, কোনো লম্বা বক্তৃতা তিনি দিতেন না, হাতে-গোনা কয়েকটি বাক্যেই তিনি জনতার বোধ-বিবেকে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন! সবাই তখন আবিস্কার করতেন, যেনো প্রত্যেকের ভিতর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে-
চেতনা এখনো নিভে নি!
বিবেক এখনো মরে নি!
দীনি মাহফিলগুলোতেও তিনি ছিলেন মাননীয় বরণীয়। এমন কি তাঁর উস্তায ও উস্তাযতুল্য মুরব্বীরাও তন্ময়চিত্তে শুনে যেতেন তাঁর বয়ান! কখনো আয়াত! কখনো হাদীস! কখনো কবিতা! কখনো আকাবিরের চেতনা-বিধৌত আবেগী বর্ণনা! সব মিলিয়ে মাহফিল হয়ে উঠতো স্বর্গীয় আবেশে প্রাণময় .. ধর্মীয় ভাবাবেগে মধুময়!!

চার.
ছাত্রদেরকে ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। তারা যেনো তাঁর নিজেরই সন্তান। দরসের ভিতরে বা বাইরে ডেকে ডেকে জানতে চাইতেন- কার কী অবস্থা .. কার কী সমস্যা। তারপর পিতৃস্নেহের মহিমায় জ্বলে উঠতেন তিনি! পকেটে নিজের অজান্তেই যেনো হাত চলে যেতো তাঁর! বের করে আনতেন স্নেহ-ভালোবাসা-ছাওয়া টাকা! তুলে দিতেন প্রিয় ছাত্রদের হাতে! তারপর স্বর্গীয় হাসির রুপালী আবীরে মুখটি রাঙিয়ে বলতেন: খরচ করো, প্রয়োজন পুরা করো!
না, গোনে গোনে কখনো তিনি টাকা দিতেন না, দিতেন পকেট খালি করে কিংবা মুঠোয় ভরে!!
ছাত্রদের সাথে এভাবেই গভীর করে মিশতেন তিনি! হয়ে যেতেন পিতার উপর আরেক পিতা! ছাত্ররা কে কেমন পড়াশুনা করছে- এ নিয়েও তিনি ভীষণ ভাবতেন। কোন্ ক্লাসে কোন্ ছাত্রটি মনোযোগী কিংবা অমনোযোগী- তারও তিনি খোঁজ রাখতেন। প্রয়োজনে ডেকে এনে উপদেশ ও অনুপ্রেরণা দিতেন। ছোট ছোট কথায় বড় বড় উপদেশ দিতেন। তাঁর সান্নিধ্যে যে-ছাত্রই আসতো, বসতো, সে-ই নিজেকে ধন্য ভাবতো।
ধন্য তুমি হে শহীদ আমিনী!

পাঁচ.
সত্যের পক্ষে তিনি ছিলেন চির অকুতোভয়। আপোষহীন সংগ্রামী। সদা নির্ভীক। এমন হবেই! হতেই হবে! কেননা তিনি বেড়ে উঠেছিলেন সত্যের সূর্যের শ্যামল ছায়ায়! তাঁর সত্য-উচ্চারণের নির্ভীকতার রহস্য এখানেই! এ-শ্যামল ছায়ায় পুষ্ট হয়ে-হয়েই তিনি সত্য-উচ্চারণকে মনে করতেন নিজের গরবের উত্তরাধিকার!
প্রিয় আমিনী! আমাদেরকে এতিম করে-যে চলে গেলেন, একটু বলেও তো গেলেন না- সত্য-উচ্চারণের এ উত্তরাধিকার কাকে আপনি দিয়ে গেছেন?!



লেখক- সাহিত্যিক ও অনুবাদক এবং লেখক ও শিক্ষক।  

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।