বাঘের বাচ্চা
টিপু সুলতান
নাজমুস সাকিব
মহীশুরের
নবাব হায়দায় আলী। তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্ম হয়েছিলো। ছেলেটি আর
দশজনের মত সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলো না। নবাবের ছেলে। সে তো হবে বীর যোদ্ধা । কিন্তু হায়দার
আলীর এই ছেলেটি বীর যোদ্ধা হওয়া তো দূরের কথা, সুস্থ ভাবে চলাফেরাও করতে পারে না। এই নিয়ে দুঃখের শেষ ছিলো না নবাব পরিবারে।
আশাহত নবাব
এখানে ওখানে ফকির দরবেশের কাছে গিয়ে তাদের দুআ চাইতেন, তার যেন একটি সুস্থ সবল পুত্র সন্তান জন্ম হয়। এক দরবেশ নবাবের
ভগ্নমন দেখে তার জন্য প্রাণখুলে দুআ করলেন। বললেন, আল্লাহ যদি
চান তবে এবার বাঘের মত সাহসী একটি ছেলে আসবে তোমার সংসারে। তার নাম রেখো ফতেহ আলী টিপু।
কানাড়ী ভাষায় টিপু মানে বাঘ।
একদিন এক
শুভক্ষণে হায়দার আলীর অপর স্ত্রী ফাতেমার গর্ভে ফতেহ আলী টিপুর জন্ম হল। কালের পরিক্রমায়
এই ফতেহ আলী টিপু সত্যি সত্যিই একদিন ‘বাঘ’ হয়ে উঠেছিলেন। বাঘের মতই গর্জে উঠেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। পাক
ভারত উপমহাদেশে তিনি আজও অমর হয়ে আছেন টিপু সুলতান নামে।
১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে
সুলতান টিপুর জন্ম হয়। ছেলে বেলায় তিনি ধর্মীয় শিক্ষা-দিক্ষা লাভ করেন। বয়সের ফাঁকে
যথাসময়ে রণকৌশলও রপ্ত করে ছিলেন। বাবার মুখে বাঘের গল্প শুনে শুনে তার মনে বাঘের জন্য
আকর্ষণ জন্ম নেয়। কিশোর বয়সে তিনি বাঘ পুষতে শুরু করেন। তার পোশাক এবং ব্যবহৃত তলোয়ারসহ
সব কিছুতেই বাঘের চামড়ার মত ডোরাকাটা দাগ ছিলো। বাঘের আকৃতিবিশিষ্ট একটি সিংহাসনও তিনি
তৈরী করেছিলেন। তার রাজ্যের প্রতীক ছিল বাঘ। তার মহলের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় বাঘের
চিত্র অঙ্কিত ছিলো। তার রাজ্যের সব সৈন্যের পোষাকে বাঘের ছবি থাকতো। তার রাজবাড়িতে
তিনি কিছু বাঘ পুষতেন এবং এগুলোর কয়েকটি তার ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকতো।
টিপু ১৭৮২
সালে ৩২ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তার সিংহাসনের অধিকারী
হন । রাজ্য শাসনের দীক্ষা তিনি বাবার কাছ থেকেই লাভ করেছিলেন। তার সাথে একাধিকবার যুদ্ধে
অংশ গ্রহনও করেছিলেন টিপু। সেসব যুদ্ধে একাধিকবার পরাজিত করেছেন ইংরেজ বাহিনীকে। টিপু
যে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন, তা ছিলো মনোরম এবং সমগ্র ভারতবর্ষের অন্যতম উৎকৃষ্ট একটি ভূখন্ড । এসব কারণে
এই সাম্রাজ্যের উপর ইংরেজদের লোভ ছিলো। টিপুর পিতা হায়দার আলীর আমলে ইংরেজরা একাধিকবার
তার উপর আক্রমণ করেছিলো। কিন্তু হায়দার আলীর বীরত্ব ও রণকৌশলের সামনে তারা টিকতে পারেনি।
সুলতান টিপুর আমলেও তারা মহীশুর দখলের ষড়যন্ত্র করেছিল। তৎকালীন লর্ড ঘোষনা করেছিলো,
সমগ্র ভারতে ইংরেজদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারে একমাত্র বাধা টিপু সুলতান।
সুলতান টিপুকে পরাজিত না করতে পারলে ইংরেজ রাজত্ব কায়েম করা সম্ভব নয়। তাই ইংরেজরা
উঠে পড়ে লেগেছিলো। টিপু সুলতানকে পরাস্ত করার জন্য তারা মালাবার দখল করে নেয়। টিপু
পুনরায় মালাবার শত্র“মুক্ত করেন। টিপুর শত্র“ ছিলো মারাঠা এবং হায়দারাবাদের নিজাম। ইংরেজরা টিপুর বিরুদ্ধে এদেরকে
লেলিয়ে দেয়। পরপর দুইবার যুদ্ধ করেও তারা টিপুকে কাবু করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তারা
একটি সন্ধির প্রস্তাব দেয়। স্বাধীনচেতা বীর টিপু সুলতান সেই সন্ধি মেনে নেননি। ফলে
টিপুর সাথে ইংরেজদের তৃতীয় দফা যুদ্ধ লেগে যায়।
এই যুদ্ধের
নেতৃত্বে ছিলো ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনোর। শেষপর্যন্ত দুর্গ এবং রাজধানী শ্ররঙ্গপত্তমের
পতন হল। বীর টিপু এই যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আত্মসমর্পণ বা রণক্ষেত্র
ত্যাগ করার চেয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করাকেই বেছে নিয়েছিলেন এই
দেশপ্রেমিক সুলতান। দিনটি ছিল ১৭৯৯ সালের মে মাসের ৪ তারিখ। এ যুদ্ধের পরাজয়ের অন্যতম
কারণ তার বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতা। এই পরাজয়ের ফলে মহীশুর ইংরেজদের দখলে চলে যায়। মৃত্যুকালে
তিনি ৪ স্ত্রী, ১৬ ছেলে এবং প্রায় ৮ মেয়ে রেখে
গেছেন। তার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ শাসকরা তার পরিবারকে মহীশুর থেকে কলকাতায় বিতাড়িত করে।
মহীশুরের রণক্ষেত্র থেকে আট মাইল দূরে পিতা হায়দার আলীর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
এখন সেখানে সুরম্য মাজার নির্মিত হয়েছে।
ব্যাক্তিগতভাবে
টিপু ছিলেন পরহেজগার এবং ধার্মিক। এ জন্যেই কেউ কেউ তাকে খোলাফায়ে রাশেদীনের সাথে গণ্য
করে থাকেন। দেশ এবং জনগণের প্রতি তার গভীর ভালবাসা ছিলো। দেশের উন্নয়নে তিনি কৃষিখাত ও শিল্পখাতে বিরাট বরাদ্দ দিয়েছিলেন। শিল্পের
উন্নয়নের জন্য ফরাসী কলাকুশলীদেরকে আমন্ত্রণ করে তার রাজ্যে এনেছিলেন। মহীশুরকে তিনি
ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা দেন। তিনি ইরান, আফগানিস্তান ও তুরস্কের খলীফার কাছে দূত পাঠান এবং খলীফার কাছ থেকে তার রাষ্ট্রের
স্বীকৃতি আদায় করেন । টিপুর প্রজ্ঞা এবং প্রচেষ্টায় মহিশুর একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে
পরিনত হয়েছিলো।
টিপুর সিংহাসন
ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইংরেজরা লুট করে নিয়ে যায়। সেসব এখনও বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত
আছে। তার একটি তরবারী ২০১০ সালের এপ্রিলে লন্ডনের একটি নিলামে ৫,০৫,২৫০ ব্রিটিশ পাউন্ড পর্যন্ত দাম উঠেছিল,
কিন্তু পরে সেটি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানান এর বর্তমান সংরক্ষক। টিপুর
একটি নিজ হাতে লেখা ডায়েরীও পাওয়া যায়। তাতে হযরত মুহম্মদ সাঃ এর প্রতি গভীর ভালোবাসা
এবং তার নিজের প্রায় ৩৭ টি স্বপ্নবৃত্তান্তও লেখা আছে।
টিপু সুলতান
একজন স্বৈরশাসক নাকি ধর্মপ্রাণ শহীদ মুজাহিদ- এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার অনন্য কীর্তি
নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তার তত্ত্বাবধানে তৎকালে বেশকিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।
সেসবের মধ্যে রয়েছে- জাওয়াহিরুল কুরআন, যাদুল মুজাহিদীন, মুফাররিহুল কুলুব। ভারত উপমহাদেশে তারই
তত্ত্বাবধানে সর্বপ্রথম উর্দু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর নাম ছিল, ফাতহুল মুজাহিদীন।
মালিবাগ জামেয়া, ঢাকা থেকে