Skip to main content

মাসিক নবধ্বনি, মে সংখ্যা, ২০১৩

আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নিরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম - কাজী নজরুল ইসলাম

যদি আর বাঁশী না বাজেআমি কবি বলে বলছি নেআমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলামসেই অধিকারে বলছিআমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুনআমি কবি হতে আসি নি। আমি নেতা হতে আসি নি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলামপ্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নিরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।



১৯৪১ সালের ৬ই এপ্রিল মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম এই অভিভাষণ দান করেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক্রুদ্ধ হয়ে যাবার আগে এই ছিল তাঁর সর্বশেষ বক্তৃতা। যাঁরা সম্যকরূপে নজরুলকে চিনতে চান, তাঁদের জন্য এই বক্তৃতার চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না। যাঁরা নজরুলকে নিয়ে অহেতুক টানাহেঁচড়া করেন, রবীন্দ্র-নজরুলের ভেদাভেদ নিয়ে ব্যস্ত তাদের জন্য নজরুল যেন নিজেই জবাব হাজির করে রেখেছেন তার এই কালজয়ী অভিভাষণে। দুঃখ-দারিদ্রের মধ্য দিয়ে কেমন করে হাসিমাখা মুখে মাথা উঁচু করে চলতে হয় তাই যেন শেখায় মিনিট ছয়েকের এই ছোট্ট বক্তৃতা। একটু খেয়াল করলেই দেখি, বিগত সাত দশকে একটি দিনের জন্য ও তাঁর এ কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক কিংবা পুরাতন মনে হয় নি। সে জায়গাটাতেই চির তরুণ বিদ্রোহী নজরুল স্বার্থক।


বন্ধুগণ, আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রান আজ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে- আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুমআমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার ধর্ম। তবু বলছি, আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্তানের পথে তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মুর্তিতে ব্যাথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। কারাগারের অন্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি।আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি । হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ। মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন,দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ। জীবনে সেই ট্র্যাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবনকে অশ্রর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু, আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত দগ্ধ। মেঘের উর্ধ্বে শূণ্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।আমার বেশ মনে পড়ছে। একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্র শোকে যখন ভেঙে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময় আমার বাড়িতে হাসনাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাসনাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য, আমার গান আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূণ্য থাকে অসময়ে নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না, আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কী দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পুর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসি নি। আমি নেতা হতে আসি নি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নিরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কতপ্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমী, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী- বিশেষনের পর বিশেষন, টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে, বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি।তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

যে বার্তা রেখে গেলেন মুফতী আমিনী উবায়দুর রহমান খান নদভী জীবন যেভাবে যাপন করবে মৃত্যুও তোমাদের সেভাবেই হবে। যেভাবে মৃত্যুবরণ করবে শেষ বিচারের দিন সে অবস্থায়ই উঠবে। জীবন- মৃত্যুর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন একটা ইশারা রয়েছে। মুফতী মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ১১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিনভর তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করেছেন। ইবাদত-বন্দেগী , খাওয়া দাওয়া , শিক্ষকতা ও ইমামতিসহ সংগঠন , রাজনীতি , বৈঠক , বিবৃতিদান সবই করেছেন। রাতের মাগরিবের পর থেকে এশা পর্যন্ত লালবাগের ছাত্রদের বোখারী শরীফ পাঠদান করেছেন। একবার বলেছিলেন শরীর খারাপ লাগছে। ১১টার দিকে বেশি খারাপ লাগায় হাসপাতালে যান। সেখানেই রাত সোয়া বারটার দিকে তার ইন্তেকাল হয়। তারিখটা পড়ে যায় ১২ ডিসেম্বর। বহুল আলোচিত ১২-১২-১২ তারিখ মুফতী আমিনী চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

মাসিক নবধ্বনি, মে সংখ্যা, ২০১৩

আলোকিত তরুণের আলোয় কিছুক্ষণ ‘ সাময়িক নাম-যশের দিকে না তাকিয়ে নিরব সাধনা চালিয়ে গেলে সুযোগ এসে ধরা দেবে ’ -   আলী হাসান তৈয়ব বর্তমান সময়ে যে কজন সম্ভাবনাময় তরুণ নিজের স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে নিবিষ্টমনে লেখালেখি করে চলেছেন- তাদের মধ্যে অন্যতম একজন আলী হাসান তৈয়ব। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলো থেকে নিয়ে গ্রাম-মফস্বলের ছোট কাগজেও তার উজ্জল বিচরণ পাঠককে মোহিত করে রেখেছে। ১৯৮২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বগুড়ায় জন্মগ্রহণকারী এ প্রতিভাবান তরুণের বাবার নাম তৈয়ব আলী পাইকার। তার মায়ের নাম আলেয়া বেগম। ২০০৫ সালে বেফাকুল মাদারিস থেকে তাকমীল বিভাগে ১ম বিভাগ প্রাপ্ত আলী হাসান তৈয়ব তার সর্বশেষ পড়াশোনা করেছেন মাদরাসা দারুর রাশাদে সাহিত্য ও সাংবাদিকতা বিষয়ে। ছোটবেলা থেকেই মাদরাসার গন্ডি পেরিয়ে তিনি জানান দিয়েছিলেন নিজের সম্ভাবনা ও প্রতিভার কথা। নাহবেমীর পড়ার সময় কৈশোর বয়সেই বগুড়ার স্থানীয় দৈনিক সাতমাথায় তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। কৈশোরে খুব বড় মাপের একজন মুফতি হওয়ার স্বপ্ন থাকলেও ভাগ্যের বাহন তাকে নিয়ে এসেছে আজকের জায়গায়। দিনরাত বিরামহীন ত...