Skip to main content

অপারেশন শাপলা


শেষ রাতের এক রুদ্ধশ্বাস অপারেশন। যাকে মানুষ বলছে অপারেশন শাপলা চত্বর। প্রায় দশ হাজার র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির যৌথ অ্যাকশন। টার্গেট ৩০ হাজারের মতো হেফাজতে ইসলামের কর্মীকে হটানো। শেষ রাতে তাদের কেউ কেউ তখন রাস্তা  বা ফুটপাতে শুয়ে। কেউ আবার স্লোগান দিচ্ছেন। উজ্জীবিত সংগীত গাওয়া হচ্ছে মঞ্চ থেকে। তাদের কারও হাতে লাঠি। কেউবা একেবারেই খালি হাতে। 

রাত তখন আড়াইটা। চারদিক থেকে হেফাজতের অবস্থান ঘিরে দাঁড়িয়ে অস্ত্রসজ্জিত ফোর্স। অপারেশন শুরুর আগে হ্যান্ডমাইকে আহ্বান জানানো হয় অবস্থান ছেড়ে দিতে। কিন্তু সেই আহ্বানের কোন সাড়া মিলছিল না। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একসঙ্গে গর্জে ওঠে অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র। সঙ্গে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট আর সাউন্ড গ্রেনেড। হেফাজতকর্মীরা কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করছিলেন। কেউ কেউ ইটপাটকেল ছুড়ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে। স্লোগানও দিচ্ছিলেন। কিন্তু অল্পক্ষণেই প্রতিরোধের শক্তি ফুরিয়ে যায় তাদের। মুহুর্মুহু গুলি আর টিয়ারশেলে আঘাতে সামনে থাকা অনেকে তখন রক্তাক্ত। কেউ আবার লুটিয়ে পড়েছেন মাটিতে। এমন অবস্থায় যে যেদিকে পারেন শুরু করেন ছোটাছুটি। টিকাটুলির দিকে রাস্তাটি ছিল পুরো উন্মুক্ত। কৌশল হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এ পথটি খোলা রেখেছিলেন যাতে হেফাজতের কর্মীরা এদিক দিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু প্রথমে হেফাজত কর্মীরা না পালিয়ে ঢুকে পড়েন আশপাশের গলিতে। তবে যৌথবাহিনীর কড়া অ্যাকশনে ক্রমে টিকাটুলি হয়ে যাত্রাবাডীর রাস্তায় সরে যেতে বাধ্য হন হেফাজত কর্মীরা। 


শাপলা চত্বরে অপারেশন শুরুর আগে একজন সমন্বয়কারীও ঠিক করা হয়েছিল। সিদ্ধান্ত হয় রাত ১২টার পরে শুরু করা হবে অপারেশন। ওয়ারলেস মেসেজের মাধ্যমে ক্ষণ পিছিয়ে বলা হয় যথাসময়ে নির্দেশ জানানো হবে। ১২টার আগেই হাজির হয়ে যায় র‌্যাব, বিজিবি ও পুলিশ। শাপলা চত্বর ঘিরে প্রধান তিনটি সড়ক ধরে পরিকল্পনা নেয়া হয়। পুরানা পল্টন হয়ে ফকিরাপুল মোড় শাপলা চত্বর। অন্য রুট হচ্ছে নটর ডেম কলেজের সামনে দিয়ে শাপলা চত্বর। আঘাত হানার পরিকল্পনা নেয়া হয় ওই দুই সড়ক ধরে। হেফাজত কর্মীদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য খোলা রাখা হয় শাপলা চত্বর থেকে টিকাটুলী সড়কসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গলি এবং বলাকা ভবনের সামনে দিয়ে রাজউক ভবন ।
যৌথ অভিযানে অংশ নেয়া সদস্যদের সাজানো হয় তিন স্তরে। প্রথমে র‌্যাব, তারপর পুলিশ, শেষে বিজিবি। পুরোপুরি এক যুদ্ধ পরিবেশে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। রাত ১টার দিকে এদিকে পল্টন ওদিকে নটর ডেম কলেজের সামনে থেকে ধীর পায়ে এগোতে থাকে র‌্যাব পুলিশ বিজিবি। বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সবাই। ওই সময় দেখা যায় পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা তাদের নিজ নিজ টিম লিডার অফিসারের নেতৃত্বে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অনুচ্চস্বরে পরামর্শ করে নেন কোন কোন গ্রুপ হাতে হাত রেখে কথা বলে আবার যাত্রা শুরু করে শাপলা চত্বরের দিকে। অনেকে ওই হাতে হাত রাখাকে শপথ বলে মন্তব্য করেন। 

রাত পৌনে ২টার দিকে নটর ডেম কলেজ ও পল্টন পাশ থেকে যৌথ বাহিনী পৌঁছে যায় সমাবেশস্থলের একেবারে কাছে। দূরত্ব তখন ১০০ থেকে ১৫০ গজ। পল্টন প্রান্ত থেকে আসা সদস্যদের মাঝ থেকে সমাবেশ লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। সমাবেশস্থল থেকে মনে করা হয় তাদের ওপর আঘাত হানা শুরু হয়েছে। সমাবেশ থেকে তখন আরও জোরে বক্তৃতা দেয়া শুরু করেন বক্তারা। এক পর্যায়ে থেমে যায় কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। রাত আড়াইটায় দুই পাশের র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবি পৌঁছে যায় একেবারে সমাবেশস্থলের কাছে। হঠাৎ করে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিয়ে হেফাজত কর্মীদের চলে যেতে বলেন। পুলিশের কথায় কান না দিয়ে আরও জোরে স্লোগান দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা। ওই সময় পুলিশের একটি রায়ট কার সমাবেশস্থলের খুব কাছে গিয়ে আবার কিছুটা পিছিয়ে এলে সমাবেশের ভেতরে একটু এলোমেলো দৌড়াদৌড়ি শুরু হওয়া মাত্র একসঙ্গে গর্জে ওঠে কয়েক হাজার আগ্নেয়াস্ত্র। টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড। গগনবিদারী শব্দ। প্রথম টিয়ারশেল ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে পল্টন প্রান্ত থেকে আসার বিজিবি সদস্যরা এক দৌড়ে প্রায় ৩শ গজ পেছনে এসে অবস্থান নেন। পুরো এলাকা ঘুটঘুটে অন্ধকার সন্ধ্যার পর থেকেই। এক ভুতুড়ে পরিবেশ। অন্ধকারে পাশের লোকটিও দেখা যায় না। গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দে হতভম্ব হয়ে পড়েন হেফাজত কর্মীরা। মুহুর্মুহু ওই গুলির আওয়াজ উপেক্ষা করেও প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন হেফাজতের কোন কোন কর্মী। ইটপাটকেল ও ছুড়তে থাকেন। নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দেন তারা। 

সমাবেশস্থল ঘিরে তখনও প্রায় ৫০ হাজার লোক। কোন কোন হেফাজতকর্মী গুলির আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। কোন কোন সহকর্মী আহতদের ধরাধরি করে নিয়ে যান। বেশির ভাগ দ্রুত দৌড়ে পালাতে থাকেন শাপলা চত্বর থেকে টিকাটুলির দিকে, কেউবা বাংলাদেশে ব্যাংকের গলি দিয়ে কমলাপুরের দিকে, বলাকা ভবনের পাশ দিয়ে রাজউক ভবনের দিকে। মাত্র দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায় শাপলা চত্বর। হেফাজত কর্মীদের বড় স্রোতটি যেতে থাকে টিকাটুলির দিকে, পুলিশ তাদের পিছু নিয়ে টিয়ারশেল ছুড়তে ছুড়তে ধাওয়া করে যাত্রাবাড়ীর দিকে নিয়ে যায়। অবস্থান নেয়া হেফাজত কর্মীদের একটি অংশ আশ্রয় নেয় বিভিন্ন ভবনের সিঁড়িতে, খোলা জায়গা ও অলিগলিতে। বিভিন্ন গলিতে আশ্রয় নেয়া হেফাজত কর্মীরা যৌথবাহিনীর সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। তাদের ইটের আঘাতে আহত হয়ে মারা যান একজন পুলিশের এএসআই। অপারেশনের শেষ পর্যায়ে দেখা যায় মতিঝিলের জনতা ব্যাংকের সামনে একজন এবং সোনালী ব্যাংকের সামনে একজন হেফাজত কর্মীর লাশ পড়ে আছে। শাপলা চত্বর এলাকায় দেখা যায় গুরুতর আহত ৭ জন গুলিবিদ্ধ হেফাজত কর্মী পড়ে আছেন মুমূর্ষু অবস্থায়। পুলিশের ওয়ারলেস সেটে শোনা যায় কিছু ক্যাজুয়েলটি আছে, লাশগুলো সরিয়ে ফেলুন এবং শোনা যায়- সিটি কর্পোরেশনকে বলুন দ্রুত শাপলা চত্বরের মঞ্চটি সরিয়ে ফেলতে। না হলে ওরা সকালে আবার এসে বসে পড়বে। শাপলা চত্বরের মূল আপারেশন দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে শেষ হলেও  গোটা মতিঝিল, টিকাটুলি, যাত্রবাড়ি ,পল্টন এলাকায় অপারেশন চলে ভোর ৬টা পর্যন্ত। শাপলা চত্বরের অপারেশ শুরুর সময় পুলিশের কয়েকটি দল থেকে ভাগ করে পুরানো পল্টন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, বিএনপি অফিস এলাকায় রাখা হয় যাতে পেছন দিক থেকে কোন আক্রমণ হলে তারা কভার করতে পারে। সাড়ে ৫টার দিকে দেখা যায় কয়েক হাজার হেফাজত কর্মী হাত উঁচিয়ে পুরানা পল্টন মোড় দিয়ে চলে যাচ্ছেন উত্তরের দিকে। পুলিশ তাদের চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। মতিঝিল এলাকা থেকে যৌথবাহিনী কয়েক শ হেফাজত কর্মীকে গ্রেপ্তার করলেও পরে তাদেরকে ছেড়ে দেয়।

দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে অভিযান শুরু হলেও হেফাজতের কর্মীদের অনেকেই তখন প্রস্তুত ছিলেন না পরিস্থিতি মোকাবিলার। সঙ্গে আনা জায়নামাজ, সংবাদপত্র, রুমাল ইত্যাদি বিছিয়ে তাদের বেশির ভাগ ফুটপাথ সড়কের আইল্যান্ড দোকানপাটের সামনে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। এমন সময় শুরু হয় যৌথবাহিনীর সশস্ত্র অভিযান। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে নিরস্ত্র মানুষের কার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা দেখার উপায় ছিল না কারও। প্রাণভয়ে আশপাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে বা জানালায় দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করছিলেন মিডিয়া কর্মীরা। তবে গুলির প্রচণ্ড শব্দ ভেদ করে মাঝে মধ্যে জনতার শোরগোল শোনা যায়। রাত প্রায় পৌনে ৩টা। যৌথবাহিনীর একটি গাড়ি বহর আরামবাগের দিক থেকে কালভার্ট রোড পর্যন্ত পৌঁছে। কিন্তু তখনও শাপলা চত্বর থেকে মাইকের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এর পর সেই শব্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। এক সময় মসজিদে আজান হয়। পুবের আকাশে দেখা দেয় আলোর রেখা। লোকজন ধীরে ধীরে নেমে আসে রাজপথে। কিন্তু যা দেখা গেল তা তিলোত্তমা নগরী রাজধানীর রাজপথ নয়। এ যেন মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত কোন নগরীর ধ্বংসস্তূপ। গতকাল দিনভর গুজব, আলোচনা ছিল যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে।

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।