Skip to main content

রংধনু

স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশায়

মাহদী হাসান


খুব ছোটবেলায় একটা স্বপ্ন দেখতাম। আমি অনেক বড় কেউ হয়ে গেছি। চারদিকে খুব সুনাম সুখ্যাতি। স্বপ্নের শুরুটা ঠিক এভাবে সুখময়তার ভেতর দিয়ে হলেও শেষটা হত বেদনার বিষাদে সাদামুখ কালো হয়ে। আমাকে কিছু করতে হলে কি আসলেই মসনদে গিয়ে বসতে হবেমসনদমুকুটরাজদন্ড এগুলোই কি একমাত্র সংস্কারের মূলমন্ত্র! আমি কি তাহলে কোনদিনই আমার স্বপ্নটি পূরণ হতে দেখতে পাব নাকোনদিন আমার প্রিয় দেশের জন্য একটি মহৎ কাজ করে যেতে পারবো না? 
বলা বাহুল্যআমার ভেতর অনিরুদ্ধ বাস করে একটি প্রতি মুহুর্ত জাগ্রত কবিসত্ত্বা। আমাকে ভাবিয়ে ক্লান্ত ধরে দেশাত্বের এই দায়িত্ববোধ আমি কিভাবে আদায় করবযদি সত্যি একদিন কিছু করতে পারিআর কিছু করতে পারার পরই তো আসবে মূল্যায়নের অমোঘ প্রশ্নটি। আমি যেভাবে চাইছি সেভাবে কাজটি করতে পেরেছি তোমানুষ খাবে তো আমার লালিত স্বপ্নটিযে কাজের বীজ আমি বপন করেছিলাম কিশোর বয়সে আমার হৃদয়ের নরম মাটিতেতারপর একটু একটু যতেœ তাকে আজ ফলদার বৃক্ষে পরিণত করেছিসেই ফল আজ মানুষের হাতেতারা কি আমার হৃদয়ের উত্তাপটি অনুভব করতে পারবেনাকি দুর্বোধ্য বলে ফেলে রাখবে গন্দা গন্দা অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের স্তুপেএমনি দুঃশ্চিন্তার ঘেরে আমার সমগ্র দিনকালগুলো কী অসহায়ভাবেই না কাটত!
নিজের এই অবস্থার দরুণ চারপাশের মানুষ- চাকরিজীবিছাত্রব্যবসায়ীরাস্তার অচেনা পথিকশহরের ভবঘুরে নাগরিক সবাইকে পরখ করতামচোখের দিকে তাকিয়ে ভাষা উদ্ধারের চেষ্টা করতামএকজনও কি আমার মতো দেশাত্মবোধের তাড়নায় অস্থিরকেউ কি আছে নিজেকে বেঁধে রাখতে চিরদিনের মতো দেশমায়ের প্রঠতির আঁচলেকেউ কি চায় নিজেকে অমর করে তুলতে মহৎ কীর্তিকর্মেবয়সের স্বল্পতার কারণেই হোক কিংবা জানার অপ্রতুলতার কারণেই হোক আমাকে বারবার হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে কলম-খাতার কাছে। হৃদয়ের ক্ষরণগুলো খাতার অবুঝ গায়ে স্মরণীয় করে রাখার নিমিত্তে। তাহলে কি আমার আশংকাই ঠিক কৃতঘœজাতি কোনদিনই অনুভব করবেনা ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের উত্তাপ।
আমি প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে পা দিলাম। আমার দেহের অবকাঠামোর সাথে লালিত স্বপ্নগুলোও বিশাল ব্যাপ্তিতে আমার ভেতরটা ফাটিয়ে দেয়ার উপক্রম করতে লাগল। স্বপ্নগুলো আর বন্দী থাকতে চাইছে না। বাইরের সুন্দর পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে বংশবৃদ্ধির পরিকল্পনায় আন্দোলন করে চলছে। কিন্তু এই স্বপ্নের কথা-চেতনার বিস্ফোরণ আমি কোথায় ঘটাবো?
আমি যখন সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে থাকি সমমনা তরুণদের সান্ত্বনায় আশ্বস্ত হই। তারা আমার চেতনাকে প্রলুব্ধ করে রাখে যূথবদ্ধ পথচলায়। কিন্তু ক্ষুদ্র এই পরিসরটুকু ছেড়ে এলেই দিশা হারানোর মতো খুঁজে ফিরি তাড়িত চেতনার আশ্রয় একটি হৃদয়। তাহলে কি কেবল প্রতিভাধররাই ভাবে দেশকে নিয়েআর লেখালেখির প্রতিভাই কি কেবল দেশাত্মবোধের চেতনায় অস্থিরআসলে সমগ্র বাঙ্গালীকে আজ বিভক্ত করেছে ভাষায় কোর্ট উইলিয়াম কলেজের মোড়লেরা। বাংলা ভাষার প্রকৃতরূপকে ঝেঁটিয়ে সংস্কৃত ভাষার ভূত বাঙালীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রটি ছিল বাঙালীর ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি কালোচিত্র।
কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মোড়লদের তৎপরতায় বাংলাভাষার যে আধুনিকায়ন ঘটেছিল তা বাংলার প্রকৃত রূপ নয়। বাংলার প্রকৃত চলিত রূপটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল মুসলমানী আমলে আরবী ফারসী শব্দ সর্বস্ব বাংলা ভাষায়। এটাই সাধারণ মানুষের প্রাণের ভাষা ছিল। এই ভাষায় সাহিত্য রচনা হতে পারলে আজ বাঙালীর ভাষাগত বৈষম্যের শিকার হতে হত না। এই আরবী ফারসী শব্দের কারণে বাংলা ভাষা ছিল হিন্দুদের কাছে চরম বিরাগ পাত্র। স্লেচ্ছ-যবনের ভাষা বনে তা রা এ ভাষা ছেড়ে সংস্কৃত ভাষায় বাতচিত করত। পরে ফোর্ট উইলিয়ার কলেজ একটি সুনিদির্ষ্ট নিয়মনীতি নির্ধারণের জন্য বোর্ড গঠন করলে তারা সংস্কৃত বাংলাকেই বাঙালীর প্রধান ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করে। কিন্তু বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের পর এই ভাষার আর অধিক প্রচলন ঘটেনি বলাচলে।
কিন্তু যে ভাষা আজ টিকে আছে আধুনিক গদ্য ভাষার আদলে তাও একেবারে অক্ষত নয়। ফলে আধুনিক সাহিত্য ভাষা আজ হয়ে উঠেছে আপাময় জনতার ভাষার বদনে শিক্ষিত বাবুদের ভাষা। তাই আজ আমজনতা- আর সাহিত্যিকদের মধ্যে এই বৈষম্য। উচ্চ শিক্ষিত হলেও অনেকের বাংলা ভাষা শিক্ষার গন্ডি পাঠশালার চৌহদ্দী পেরুতে পারেনি। কারও কারও শিক্ষার শুরু শেষ বিদেশী ভাষার প্রেমেই সারা হয়। সাহিত্যিকরা উন্নত চিন্তা মননধর্মী শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন এখন একরকম নিজের আনন্দে আর পেটের দায়ে। সাধারণ্যের তাতে ভাগ বসানোর দায় থাকেনা। এভাবে ভাষাগত বৈষম্যের বিষফোঁড়ায় একদিন বাঙালীর সভ্য সমাজের ইতি ঘটবে তার বেশি দেরি নেই। সেদিন নৈতিকতা ও মানবিকতার প্রশ্নে প্রকট হবে বাঙালীর মন মসনদে নিজস্ব সাহিত্যভাষার সংকট।
খুব ছোট বয়সে লালিত স্বপ্নটি আজ যে সাহিত্যিকতায় বিকশিত হতে চেয়েছিলবাঙালীর মন-মানসে ভাষার নৈতিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে চেয়েছিল তারও সম্ভাবনার পথ বন্ধ বাঙালীর মুখের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষাদ্বন্দের কারণে।

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।