চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী
মুহাদ্দিস আল্লামা নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.)
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর
একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের
ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক, জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ., খতিব মাওলানা
আমিনুল ইসলাম (রহ.), সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান, মুফতিয়ে আযম
মাওলানা আহমদুল হক (রহ.), পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.), কুতুবে যামান
মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব
হুজুর) (রহ.), প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.), শায়খুল হাদীছ
মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।
সম্প্রতি বিদায় নিয়ে গেলেন দ্বীনি আন্দোলনের নির্ভীক
সিপাহ্সালার আল¬ামা মুফতি ফজলুল হক আমিনী (রহ.)ও। সেই শোকের
রেশ না কাটতেই বিদায়ী বুযুর্গানে দ্বীনের তালিকায় গত ১২ ফেব্র“য়ারী, মঙ্গলবার
যুক্ত হলো আরো একটি নাম ‘ মাওলানা নুরুল ইসলাম
জদীদ (রহ.)’। যিনি প্রায় অর্ধশত
বছর ধরে উপমহাদেশের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়
হাদীসে নববী (স.) এর র্দস দিয়েছেন, হাজার হাজার ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়েছেন ইলমে দ্বীনের
আলোকরশ্মি, সমাজশুদ্ধিতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান, ছিলেন
আধ্যাত্মিক জগতের নিভৃত পথচারী। গত ১২ ফেব্র“য়ারী, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি আমাদের কাঁদিয়ে মহান আল্ল¬াহর সান্নিধ্যে চলে যান, চট্টগ্রাম ফটিকছড়ির দৌলতপুর নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন, ইন্না লিল¬াহি ওয়া ইন্না
ইলাইহি রাজিউন।
এমন সত্যিকারের আলেমেদ্বীন তথা ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ায় চিরবিদায় পক্ষান্তরে
একটি জগতের মৃত্যু। এসব বুযুর্গানে দ্বীনের ইন্তেকাল যেন আমাদের মাথার ওপর থেকে
ক্রমশ রহমতের ছায়া সরে যাওয়ার নমুনা। নবী করীম (স.) ইরশাদ করেন, ‘মাওতুল আলিমি মাওতুল আলম’ অর্থাৎ একজন আলেমেদ্বীনের মৃত্যু একটি জগতের মৃত্যুর মতো।
কারণ হক্কানী ওলামায়ে কেরামই দিকভ্রান্ত জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেন, ইলমে নববীর
জ্যোতি ছড়িয়ে জগতকে করেন আলোকিত, বিশ্বময় ছড়িয়ে দেন শান্তি-সম্প্রীতির বাণী। তাই সত্যসেবী
ওলামা-মশায়েখের ইন্তেকালে জনসমাজ শুধু নয়; প্রকৃতি তথা আকাশ বাতাসেও সৃষ্টি হয় শোকের আবহ্।
মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আকাশ, নিঃসৃত হয় শোকের অশ্র“ধারা। প্রায় বুযুর্গ আলেমেদ্বীনের ইন্তেকালে
আমি তেমনটাই অনুভব করেছি।
প্রখ্যাত হাদীছ বিশারদ মাওলানা নুরুল ইসলাম জদীদ সাহেব হুজুর (রহ.) এর
ইন্তেকাল সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আলেম সমাজ, তাঁর ছাত্র, ভক্ত ও
স্বজনদের মাঝে যেমন নেমে আসে শোকের ছায়া, সেদিন আকাশও যেন শোকাচ্ছন্ন হয়েছিল। ১২ ফেব্র“য়ারী, বাদ এশা (রাত
পৌনে ৮টায়) নিজের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের স্মৃতিবিজড়িত জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার
বিশাল ময়দানে মরহুমের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। মরহুমের বড় ছেলে, জামিয়া
ইসলামিয়া পটিয়ার শিক্ষক মাওলানা জাকারিয়া আল-আজহারী জানাযার নামাজে ইমামতি
করেন। দেশের শীর্ষ আলেমেদ্বীন মুফতি আব্দুর রহমান, মাওলানা
সুলতান যওক নদভী, মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীসহ হযরতের অগণিত ছাত্র-শিষ্য, ভক্ত, আলেম সমাজ, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক
নেতৃবৃন্দ এবং হাজার হাজার শোকার্ত তৌহিদী জনতা হযরতের জানাযায় শরীক হয়ে মহান
আল্ল¬াহর কাছে মরহুমের রুহের মাগ্ফিরাত কামনা করেন এবং তাঁকে অশ্র“সিক্ত বিদায়
জানান। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে, ২ মেয়েসহ
অসংখ্য ছাত্র. হাজার হাজার ভক্ত, মুরিদ ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মাওলানা নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) ১৯২০ সালে চট্টগ্রাম
ফটিকছড়ি থানার দৌলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আলী মিয়া
সওদাগর। তিনি নাজিরহাট নাছিরুল ইসলাম (নাজিরহাট বড় মাদ্রাসায়) প্রাথমিক থেকে
মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর কিছুকাল জামিয়া ইসলামিয়া মঈনুল ইসলাম
হাটহাজারীতে অধ্যয়ন করে উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিখ্যাত
শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দে পাড়ি জমান। সেখাতে তিনি দীর্ঘ ৫বছর পড়ালেখা
করে দাওরায়ে হাদিস, তাফসীর ও ইসলামী দর্শনে কৃতিত্বের সাথে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ
করেন। তিনি ক্বেরাত শাস্ত্রেও উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছিলেন। তিনি বৃটিশ বিরোধী আযাদী
আন্দোলনের অগ্রদূত আল্ল¬ামা হোছাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর বিশিষ্ট
শাগরিদ।
এছাড়াও তাঁর শিক্ষকগণের মধ্যে আল¬ামা এজাজ আলী
(রহ.), আল¬ামা ইব্রাহিম বালিয়াভী (রহ.) ও আল¬ামা ইছহাক আল-গাজী (রহ.) অন্যতম। জাতীয় মসজিদ বায়তুল
মোকারমের মরহুম খতিব আল¬ামা ওবাইদুল হক (রহ.) তাঁর ঘনিষ্ট সহপাঠী।
শিক্ষা জীবন শেষে তিনি নাজির হাট বড় মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবনের
সূচনা করেন। সেখানে তিনি ৪ বছর দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর কিছুকাল বাবুনগর
মাদ্রাসায় অধ্যাপনারত ছিলেন। তিনি ১৩৮৬ হিজরীতে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার
সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। তখন থেকে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি
সুদীর্ঘ প্রায় অর্ধশত বছর যাবৎ আল-জামেয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ায় হাদিসের কিতাব
বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ, মুসলিম শরীফসহ
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির পাঠদান করেন। তাঁর বহু ছাত্র দেশবিদেশে ইসলাম ও
জাতির খেদমতে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
আধ্যাত্মিক জগতেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক
রাহবার আল্ল¬ামা হাকিম আখতার (রহ.) এর খলিফা ছিলেন। তিনি
খতিবে আযম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) ও মাওলানা আত্হার আলী (রহ.) এর সাথে ইসলামী
নেজাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা রাখেন। ইবাদত-বন্দেগী, দাওয়াত, তা’লীম, চলাফেরা, বেশ-ভূষণ, আলাপচারিতাসহ
সামগ্রিক জীবনাচারে তিনি ছিলেন সুন্নাতে নববী (স.) এর বাস্তব অনুসারী। অহংকার
মুক্ত জীবন, ভদ্রতা ও স্পষ্টবাদিতা তাঁর চরিত্রের অনন্য ভূষণ। তিনি অনেক
কিতাবাদিও রচনা করেন। তৎমধ্যে শরহু ক্বলা আবু দাউদ ‘আত্-তাশরীহুল মনদুদ’, শরহে জামী বহছে ফে’ল এর (শরাহ্) ব্যাখ্যা গ্রন্থ, শরহে তিরমিযী ‘লুবাবুন নুকুল’ উলে¬খ্যযোগ্য। সারাটি জীবন ইলমে দ্বীন আহরণ ও
বিতরণে কাটিয়ে তিনি আল¬াহর রাহ্ েনিজেকে সপে দেওয়ার অনুসরণীয় নজির
স্থাপন করে গেছেন। আজীবন তিনি ছিলেন সত্যের পথে অগ্রণী, বাতিলের
প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ। উম্মাহ্ চরম ক্রান্তিলগ্নে হযরতের মত একজন যোগ্য দিকনির্দেশক
ও সাহসী অভিভাবকের খুবই প্রয়োজন ছিল। তাঁর ইন্তেকালে জাতি হারাল হকের ঝান্ডাবাহী
একজন মর্দে মু’মিন। হারাল একজন প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস, খালিস বুযুর্গ, দ্বীনি
দরস্গাহ্র যথার্থ শিক্ষক, ইসলামী জাগরণের অন্যতম সিপাহ্সালার। বর্ষীয়ান এই
আলেমেদ্বীন ও বুযুর্গ মনীষীকে হারিয়ে আমরা আজ গভীর শোকাভিভূত। আমরা মহান আল¬াহর নিকট মরহুমের রুহের মাগ্ফিরাত এবং জান্নাতে তাঁর সুউচ্চ
মকাম কামনা করি- আমিন!
লেখক ঃ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।