Skip to main content

কলাম



মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় যে সংঘাতের রাজনীতিকে উসকে দিয়েধর্মপ্রাণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে দেশটাকে আরও অস্থিরঅশান্ত করে তোলা

লিখেছেন - পীর হাবিবুর রহমান



সরকার বিলম্বে হলেও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করে জ্বলন্ত উনুনে পানি ঢেলেছিল।
তাদের শান্ত করতে, দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে স্বস্তি দিতে কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেফতারও করেছে। সরকারের তদন্তেই বেরিয়ে আসত আটকরা অপরাধী কি না। অপরাধী হলে ব্যবস্থাও নিত। একই সঙ্গে সরকার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপরাধে তথ্য ও প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে দুই বছরের জায়গায় ১০ বছর ও এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান করার ঘোষণা দিয়েছিল। এ অবস্থায় হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ অনেকটাই শান্তিপূর্ণভাবে শুরু ও শেষ হবে এমন ধারণাই জনমনে দেখা দিয়েছিল। হরতালের দেশ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোথাও ছুটির দিন বিশেষ করে সূর্যাস্তের পর হরতাল শুরু না হলেও শাহরিয়ার কবির আর নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুরা শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত লংমার্চ প্রতিরোধে হরতাল দিয়ে জ্বলন্ত উনুনে ঘি ঢাললেন। এ কেমন রাতের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী স্বভাবসুলভ রসিকতায় একবার নিশিকুটুম্ব বলেছিলেন বিএনপিকে মধ্যরাতের টিভি টকশোর অতিথিদের সিঁধেল চোর।

তাহলে এই রাতের হরতালকারীদের কী নামে ডাকবেন আজ! শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকার এসব উদ্যোগ নিয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির দুজন নষ্ট বাম নেতা ছাড়া সবাই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ইতি টানার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। একইভাবে ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল ও মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ হেফাজতে ইসলামের লংমার্চের প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন। ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে লালন করেই আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশেরই জন্ম দেননি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

৭ মার্চের বক্তৃতায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, 'আমি মুসলমান। মুসলমান একবার মরে। বার বার মরে না।' তিনি পরে 'কারও মাখা তামাক খাই না' বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেকের আপত্তির মুখেও ওআইসি সম্মেলনে গিয়েছিলেন। আজীবন সমাজতন্ত্রের রাজনীতির পথে হাঁটা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ছড়িয়ে দিলেও ব্যক্তিগত জীবনে তার যেমন মুরিদ ছিল তেমনি তিনি ছিলেন ভীষণ পরহেজগার ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সামনে রেখে রাজনীতি করা নেতা। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও ধর্ম-কর্মকে সমাজতন্ত্রের আগে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তারা বা তাদের দল কখনো রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনেননি। আনতে দেনওনি।

কিন্তু ধর্মকে টেনে না আনলেও এ দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে তারা বুঝতেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কারণে বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল নেতৃত্বের মোহনীয় ব্যক্তিত্ব ক্ষমতায় থাকার পরও, মওলানা ভাসানী, কমরেড মণি সিং ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদদের মতো নেতা পাশে থাকার পরও; মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যখন ইসলামী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল তখন দেশবরেণ্য লেখক, কবি দাউদ হায়দারকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। কারণ এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান ধর্মের ওপর কোনো আঘাত বরদাস্ত করে না। অন্য ধর্মের ওপর আঘাতও নয়। আজকের বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে ধর্মের রাজনীতির বিকাশই ঘটেনি, ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাও বেড়েছে। 

এ দেশের জনগণ ৪২ বছর ধরে কোনো নির্বাচনেই বামপন্থি ও ইসলামপন্থি দলের পক্ষে গণরায় দেয়নি। এখানে মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত বিশ্ব ইজতেমা তুরাগতীরে হয়। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমা ছাড়াও প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে মুসলি্লদের সে াত নামে। সকাল থেকেই মুসলমানদের মধ্যে জুমার নামাজ নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়। এ দেশেই পহেলা বৈশাখ, রমনার বটমূলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। একুশের প্রভাতফেরি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে নামে গণমানুষের ঢল। ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর এবং দুর্গাপূজা থেকে বড় দিন নিজ নিজ ধর্মের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন করে। অন্য ধর্মের মানুষ নিয়েও সবাই এ আনন্দ ভাগাভাগি করে আসছেন দীর্ঘকাল থেকে। সিলেটে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে বাস করেন ইসলাম প্রচারক হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হিন্দুদের শ্রীচৈতন্যদেব। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় সব বড় দলই কম-বেশি ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে এনেছে। 

এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা বড় হলেও আওয়ামী লীগের অবদান ছোট নয়। রাজনীতি জনকল্যাণের জন্য হলেও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়িপথে পাশের দেশেও নির্বাচনী কৌশল ও ঐক্যের ঘটনা ঘটে থাকে। কলকাতার মমতা কখনো বিজেপি কখনো জোট বাঁধেন কংগ্রেসের সঙ্গে। '৭১-এর ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপি যেমন সরকার গঠন করেছে, তেমনি আগামী দিনে ক্ষমতায় যেতে আন্দোলন ও নির্বাচনী ঐক্য গড়েছে। '৯৪ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে নীতিহীন ঐক্য করলেও রাজনৈতিক কৌশলে তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। সব শ্রেণী-পেশার মানুষ নিয়ে পথচলা দলটি '৯৬ সালের নির্বাচনে প্রথম ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন তারা ভালো করেই জানেন আওয়ামী লীগ সেদিন ক্ষমতায় না এলে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারার রাজনীতি আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত। 

যারা শাহবাগের পক্ষে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চান তাদের বুক ফুলিয়ে হাঁটতে হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে এত প্রভাব নিয়ে চলতে দেখা যেত না। ড. আনোয়ার হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতেন না। এমনকি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর গলায় স্বাধীনতা পদক ঝুলত না। অধ্যাপক মুনতাসির মামুনসহ কোনো কোনো সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী সরকারি হজ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে সৌদি আরব যেতে পারতেন না। ম. হামিদরা বউ নিয়ে সরকারি করুণার পদ নিতে পারতেন না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ২২ বছর ধরে আওয়ামী লীগের বিপরীতে ক্ষমতার রাজনীতিতে বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি। সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসতে এ দুই দলের বাইরে অবদান রাখার জন্য যদি কোনো দলের নাম নিতে হয় সেটি জাতীয় পার্টি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে সরকার ও বিরোধী দলের নূ্যনতম সমঝোতার বিকল্প নেই। বিএনপি পার্টনার জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের ওপর চরম দমননীতি চালিয়েছিল। এবার আওয়ামী লীগ দলে আশ্রিত নষ্ট বাম ও জোটভুক্ত দেউলিয়া উগ্র ও চীনপন্থিদের নিয়ে দমননীতির শাসন কায়েম করেছে।

ওয়ান-ইলেভেন মাঝখানে এসে আওয়ামী লীগকে প্রজ্ঞাবান, জনপ্রিয় নেতাদের সাংগঠনিক কাঠামো থেকে বাইরে ছুড়ে দিয়ে দলটিকে অতিশয় দুর্বল করে দিয়েছে। বিএনপিরও একই অবস্থা। তবে আওয়ামী লীগের মতো নয়। আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকলেও দলটিতে আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ নেই। আছে নষ্ট বামদের। তারা চলছে অদৃশ্য শক্তির ইশারায়। গণভিত্তি না থাকায় তাদের করুণালাভের জায়গা দেশের মানুষের কাছে নয়। আছে অন্যখানে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলেও শাহবাগের ইতি ঘটাতে পারেননি। উনার ডানে-বাঁয়ে ও বাইরে যারা কাজ করছেন তারা পরিস্থিতিকে সংঘাত ও অশান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। বিষয়টা সবাই বুঝতে পারলেও মতলবটা কী, তা কেউ জানেন না। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে প্রজ্ঞাবান নেতারা বাদ পড়ায় সরকার রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলায় কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষা আর শরিকানাদের কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষা ভিন্ন ভিন্ন মেজাজে আসছে। উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।

মানুষ শান্তি ও স্থিতিশীলতা চেয়েছিল। মানুষ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা, কার্যকর সংসদ দেখতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় জীবনে গণতন্ত্রের জৌলুস আসা দূরে থাকুক ২২ বছরে দিনে দিনে সব দল থেকেই গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছে, যা হচ্ছে লোক দেখানো। দুর্নীতি, দুঃশাসনের অভিযোগে সেনাশাসক এরশাদের পতন ঘটালেও জনগণ দেখেছে প্রতিটি শাসনামলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কেমন করে দুর্নীতি সর্বকালের রেকর্ড ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির চিত্র হয়ে উঠেছে ক্ষমতায় গেলেই শাসকদের ছায়ায় ও আশপাশে থেকে রাতারাতি বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যাওয়া। দেশে সুশাসন নির্বাসিত হলেও প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ছে দেশ। সেবারও, এবারও। কী অন্ধ দলকানা, দলদাসদের আজ্ঞাবহতা সব পেশার মানুষকে গ্রাস করেছে! সারা দেশে সেবারও জনপ্রতিনিধিদের সিন্ডিকেট মিলে লুটেপুটে খেয়েছে, এবারও খাচ্ছে। মানুষ বিক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট। তাই এককালে এ দেশে ছাত্রনেতারা যে সম্মান পেতেন আজ মন্ত্রী-এমপিরাও তা পান না। এতে যেন তাদের কিছু যায় আসে না। দলীয়করণ সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কেন জনসমর্থন হারিয়ে টাইটানিকের মতো ডুবেছিল_ সেই প্রশ্নের উত্তর এবারের ক্ষমতাসীনরাও খুঁজছেন না।

ওয়ান-ইলেভেনের নির্যাতনের ক্ষত দুই দলের শরীর ও মন থেকে কীভাবে যে মুছে গেল তাও মানুষ বুঝতে পারে না। জনগণের ট্যাঙ্রে টাকায় সব সুযোগ-সুবিধা ও বিশ্ববিখ্যাত ট্যাঙ্ফ্রি গাড়ি চড়ে বেড়ালেও সংসদে যেতে নারাজ বিরোধী দলের এমপিরা। জনগণের ভোটের আমানতের মর্যাদা দিতে নারাজ সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা। কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে এ সুযোগে সিভিল প্রশাসনের দলবাজ বিশাল অংশ সেবারও দুর্নীতির শরিকানা নিয়েছিল, এবারও নিচ্ছে। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার ও বিরোধী দল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নূ্যনতম সমঝোতার ভিত্তিতে ভূমিকা রাখবে, পাঁচ বছর পর নির্বাচনে জনগণ যাকে খুশি তাকে নির্বাচিত করবে এভাবেই দেশটি চলার কথা ছিল। সরকার ও বিরোধী দল সেই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। সরকারের এ ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখার কথা তারা তা রাখেনি। বিরোধী দল যে দায়িত্ব পালন করার কথা তা পালন করেনি। 

এখন দেশে নির্বাচনী প্রচারণা, মনোনয়নলাভের দৌড়ঝাঁপ চলার কথা ছিল। সব বন্ধ হয়ে গেছে। সংঘাত, সহিংসতায় মানুষের প্রাণহানি ও অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্চে। রাজনীতি যে কার জন্য করছেন, কীসের স্বার্থে যে এই সর্বনাশা আগুন নিয়ে খেলা তা কেউ বুঝতে পারছে না। কী এক অদৃশ্য শক্তি যেন আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় জীবনের সুখ কেড়ে নিয়েছে। রাজনীতির প্রতি মানুষকে ক্রমাগত ক্ষেপিয়ে তুলছে। বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, সংঘাত, সহিংসতা অব্যাহত থাকলে দেশ জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। গত দুই মাসের ঘটনাপ্রবাহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশকে অন্য চেহারায় উপস্থাপন করছে।

এ জায়গা থেকে বেরিয়ে না এলে মূল্য আরও বেশি দিতে হতে পারে। 
হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি নিয়ে সরকার শেষ মুহূর্তে হলেও যে পথ নিয়েছিল তাতে পরিস্থিতি অনেকটাই সীমানার ভেতরে ছিল। হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ লংমার্চ হবে। দলের নেতাদের দিয়ে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে আলোচনাও করাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন স্থানে। সরকার লংমার্চে লোকসমাগম কমানোর কৌশলও নিয়েছিল। এমনকি ব্লগারদের গ্রেফতার করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরও সন্তুষ্ট করার পথে হাঁটছিল। কিন্তু, বুধবার সন্ধ্যায় হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা শফি যখন ঢাকায়, তাদের প্রস্তুতি যখন প্রায় সম্পন্ন ঠিক তখন '৭১-এর ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটির শাহরিয়ার কবির আর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুরা এই লংমার্চ প্রতিরোধে আজ শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে কাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হরতালের ডাক দিয়েছেন! যারা দলীয় আনুগত্যের বাইরে বাস করেন তারা তো বটেই দলবাজরাও অবাক হলেন। 

বিস্ময় প্রকাশ করলেন। এ দেশে যখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তখন তাদের প্রতিবাদে হরতাল ডাকা দূরে থাক, রাজপথে মিছিল করতেও দেখা যায়নি। যখন আজকের প্রধানমন্ত্রীর ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হলো তখনো তাদের প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি সেভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিবেশ তৈরিতে তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে যারা লেখালেখি করেছিলেন তাদেরই একজন শাহরিয়ার কবির। এককালের চীনা বাম শাহরিয়ার কবিররা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতির জীবনে নেমে আসা অন্ধকার সময়ে কী ভূমিকা রেখেছিলেন তা তিনি ভুলে গেলেও মানুষ ভোলেনি। আজ সরকারের ছায়ায় থেকে পুলিশ প্রহরায় হেঁটে রাতের বেলা হরতাল ঘোষণা করে যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার নেপথ্য কারণ আগামী দিনে অবশ্যই উদঘাটিত হবে। কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় কোন মতলবে সরকারের কাঁধে দায় চাপিয়ে এই হরতাল ডেকেছেন কার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তা উন্মোচিত হবেই। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বলেছে, সন্ধ্যার মধ্যে হরতাল প্রত্যাহার করা না হলে ৭ তারিখ থেকে লাগাতার হরতাল দেবে তারা।

একই দিকে শাহরিয়ার কবির-বাচ্চুরা হেফাজতে ইসলামের লংমার্চকে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট বলে দাবি করেছেন। শাহবাগের কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে হেফাজতে ইসলামের এ কর্মসূচিকে ১৮ দল সমর্থন দেওয়ায় এটিকে নাকি আর নির্দলীয় কর্মসূচি বলার সুযোগ নেই। তারা হরতাল সফল করতে ও স্বাধীনতাবিরোধীদের রুখতে তৃণমূল পর্যায়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের আহ্বান জানান। তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি করবে এ গ্যারান্টি কে দিয়েছে এ প্রশ্ন তুলেছেন শাহরিয়ার কবির। অদ্ভুত রাতের হরতালের কর্মসূচি। অদ্ভুত হঠকারিতার এই রূপ! পায়ে পায়ে ঝগড়া বাধাবার। এ হরতাল কর্মসূচিকে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম সমর্থন জানিয়েছে বলে জানান সংবাদ সম্মেলনকারীরা। এরাই শাহবাগের তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত স্কয়ারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় জনগণের সামনে দৃশ্যমান হয়েছিল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ সরকার প্রযোজিত।

তেমনি আজকে এ কথা অনেকেই বলবেন হেফাজতের বিরুদ্ধে এই হরতাল সরকারই ডাকিয়েছে। এ অবস্থায় হরতালকারীরা রাতের হরতালের ষড়যন্ত্রের কর্মসূচি দিয়ে দেশকে সংঘাতের পথে হাঁটার উসকানিটাই দিলেন। তারা যেন চাইছেন হেফাজতে ইসলামকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ঠেলে একাকার করে দিতে। ধর্মপ্রাণ মানুষকে দূরে সরিয়ে দিতে। ঢাকায় গোলটেবিল, চার হালি মানুষের মানববন্ধন, তাত্তি্বক গবেষণার সঙ্গে গণমানুষের রাজনীতির কোনো মিল নেই। সরকার প্রযোজিত নাটক-সিনেমাই যেখানে দর্শক টানে না, সেখানে রাজপথের কর্মসূচি গণমানুষকে বিক্ষুব্ধ করতে পারবে, টানতে পারবে না। আর রাতের হরতাল দিয়ে তারা কেন সংঘাতের পথ উসকে দিলেন? তবে কি এ দেশকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বৃত্ত থেকে বের করে তালেবানি রাষ্ট্রের দিকে নিতে চান? পাকিস্তানের অভিশপ্ত পরিস্থিতি টেনে আনতে চান? কী চান তারা আজ? আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে হটিয়ে ইসলামপন্থিদের শাসন? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। জনগণ সেখানে সমর্থন দিচ্ছে। সংবিধান ও আইন-বিধিবিধান বলে সরকার দেশ পরিচালনা করবে, আমরাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় যে সংঘাতের রাজনীতিকে উসকে দিয়ে, ধর্মপ্রাণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে দেশটাকে আরও অস্থির, অশান্ত করে তোলা।

সূত্র- বাংলাদেশ প্রতিদিন

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।