Skip to main content

জীবন থেকে নেয়া


যে ঘটনা বদলে দিয়েছিল
 

আমাদের জাতীয় কবির জীবন

তামীম রায়হান


আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ঘরে জন্ম নেয়া ২য় ছেলেটির নাম ছিল বুলবুল। পুরো নামে অরিন্দম খালেদ বুলবুল। কবি তার এই ছেলেটিকে খুব ভালবাসতেন, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। বাবা হিসেবে মনের মত করে তিনি তাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার জীবন ও যৌবন সাজাতে চেয়েছিলেন।
ছোট্ট বুলবুল এর গলাও ছিল অসাধারণ মিষ্টি। কবির সাথে যারা আড্ডা দিতে তার বাসায় আসতেন, তারাও তাকে আদর করতেন, তার মুখের কথা ও বুলি শুনে অবাক হতেন। শুধু কি তাই, কবি যখন হারমোনিয়াম হাতে নিয়ে কোন সুর বাজাতেন, ছোট্ট ছেলে বুলবুল সবাইকে তাক লাগিয়ে বলে দিত, আব্বু এখন এই গানটি করবেন, এ বাজনা এ গানেরই। তার গলায় গান শুনে অবাক হয়েছিলেন তৎকালে কবির বন্ধুবান্ধবরাও।



কবি যেখানে যেতেন, এই ছোট্ট খোকাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বুলবুলকে নিয়েই কেটে যেত তার হাসি আনন্দে ভরা উচ্ছল সময়গুলো। বাধা বন্ধনহীন কবির ছন্নছাড়া জীবন ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল হয়ে উঠছিল বুলবুলকে ঘিরে।
জন্মের পর থেকে দুঃখ যার নিত্য সঙ্গী, সেই দুখুমিয়া কবি নজরুলের কপালে এ সুখ আনন্দ বেশীদিন সইলো না। অল্প বয়সে কবির ছেলেটি গুটি বসন্ত অসুখে আক্রান্ত হয়ে চলে গেল পরপারে।

আদরের প্রথম সন্তান ছোট্ট খোকা বুলবুলের এ মৃত্যু কবিকে মানসিক ভাবে ভেঙে চুরমার করে দিল। জীবনের প্রথম স্বপ্নসৌধ অবেলায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল সদা হাস্যপ্রাণ কবি নজরুলের। মাত্র কয়েক লাইন লিখে কবির দুঃখ বেদনা আর মুষড়ে পড়ার কথা এখানে বুঝানো অসম্ভব। কবির এ ছেলেটি ট্যাক্সীতে চড়তে পছন্দ করতো, তাই তার মৃত্যুর পর লাশটি ট্যাক্সীতে বহন করে কবি কবরস্থান পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন।
কবির বন্ধুদের লেখায় দেখা যায়, কাঁদতে কাঁদতে কবির চোখদুটো ফুলে গিয়েছিল, নাওয়া খাওয়া ভুলে এমন ঞ্চল কাজী নজরুল একেবারে নীরব হয়ে গেলেন, তার হাস্যরস থেমে গেল কয়েকদিনের জন্য, এতে কতখানি শোকে বিদ্রোহী কবি পাথর হয়ে চুপচাপ হয়ে যেতে পারেন, তা অনুমান করা হয়তো কিছুটা সম্ভব।
পুত্র বুলবুলের সব খেলনা ও জামা কাপড় কবি পরম আদরে সাজিয়ে রেখেছিলেন। তাকে সান্তনা জানিয়ে তার বন্ধুরা যেসব চিঠিপত্র পাঠাতেন, সেসব পড়ে কবি কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতেন নয়নের জলে। বুলবুলের চিকিৎসায় তার অনেক টাকাও খরচ হয়েছিল, কাজেই মৃত্যুশোকের সাথে এবার যোগ হল অর্থকষ্ট।
ভরাক্রান্ত কবির কাছে এ দিনগুলো ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছিল। তার জীবনীকারদের কেউ কেউ লিখেছেন, প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর থেকে কবির জীবনে একটি ভাবান্তর আসে, কবি তখন সবার অলক্ষ্যে আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে আসক্ত হয়ে পড়েন, তার রচনা ও লেখার স্রোত ধীর হয়ে আসে, এভাবে চলতে থাকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত, এরপর তো তিনি চিরতরে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
এমনই একটি ঘটনা তুলে ধরছি, পঞ্চানন ঘোষাল তখন কলকাতার তরুণ পুলিশ অফিসার। কাজী নজরুলকে তিনি ভালোবাসেন এবং মাঝে মাঝে তার সাথে গল্প করেন। একবার কোনো এক কারণে কবির বাসায় তল¬াশীর হুকুম এল উপর থেকে। এ বেচারাকে দায়িত্ব দেয়া হল সে দলে থাকার।

গোয়েন্দারা তাকে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল কবির ঘরের। কাজী নজরুল দরজা খুলে দিলেন এবং সঙ্গত কারণে এই তরুণ অফিসার এবং কবি দুজনই পরস্পরকে তখন না চেনার ভান করে রইলেন। গোয়েন্দা পুলিশের দল কবির ঘরে সবকিছু তছনছ করে তল¬াশী চালাচ্ছে, কবিও তাদেরকে যথাসম্ভব বাক্স খুলে খূলে দেখাচ্ছেন। হঠাৎ ঘরের কোনে পরম যতেœ উঠিয়ে রাখা একটি বাক্সে নজর পড়ল তাদের। তারা সেটি খুলে দেখতে চাইল। কবি অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, না না, ওটাতে হাত দিবেন না যেন।
কবির বিচলিত মুখভঙ্গি দেখে পুলিশদের সন্দেহ আরো তীব্র হল। তাদের একজন সজোরে সেটি খুলতেই সেই বাক্সটি থেকে ঝরে পড়ল কিছূ খেলনা আর ছোট ছোট জামা কাপড়সহ বাচ্চাদের অন্যান্য সামগ্রী।
এভাবে সেগুলো আছড়ে মাটিতে পড়তে দেখে কবির দু চোখ পানিতে ভরে গেল। ঝরঝর করে তিনি কেঁদে দিলেন সবার সামনে। এমন সুকঠিন মুখখানা তার ব্যাথায় ও দুঃখে কালো হয়ে এল। এ খেলনা ও ব্যবহার্য সামগ্রীগুলো ছিল কবির আদরের সন্তান এই ছোট বুলবুলের। তার মৃত্যুর পর এসব বুকে জড়িয়ে কবি সান্তনা খূঁজে পেতেন, আদর আর চুমো পৌঁছে দিতেন বুলবুলের গালে। পরবর্তীতে এ অফিসার তার এক লেখায় নিজেকে অত্যন্ত ব্যর্থ ও লজ্জিত উলে¬খ করে লিখেছেন, এরপর কত মানুষের কত ঘর সার্চ করেছি, কিন্তু সেদিনের মতো এমন কষ্ট আর কোথাও পাইনি।

কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন তার বুলবুলকে নিয়ে, আমার কাননের বুলবুলি উড়ে গেছে, যে দেশে গেছ তুমি- সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও বেশী সুন্দর।
আরেক জায়গায় লিখেছেন, আমি যখন আমার পথ খুঁজছি, তখন আমার প্রিয়তম পুত্রটি সেই পথের ইঙ্গিত দেখিয়ে আমার হাত পিছলে মৃত্যুর সাগরে হারিয়ে গেল। মৃত্যু এই প্রথম আমার কাছে ধর্মযাজকরূপে দেখা দিল, সেই মৃত্যুর পশ্চাতে আমার অন্তরাত্মা নিশিদিন ফিরতে লাগল...ধর্মরাজ আমার পুত্রকে শেষবার দেখিয়ে হেসে চলে গেলেন।
এ সময় কবি প্রায়ই ধ্যানমগ্ন থাকতেন, নীরব হয়ে দিন কাটাতেন। কখনো কখনো অস্বাভাবিক কিছু কথা বলতেন। এমনকি এ দুরন্ত কবি তার বন্ধুদেরকে, যাদেরকে নিয়ে দিনরাত ভুলে হাসি আড্ডায় মেতে থাকতেন, তাদেরকে একবার বলে ফেললেন, আমি এ ভারতের সর্বসেরা ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি।

আমাদের জাতীয় কবির দুঃখভরা জীবনে বুলবুলের মৃত্যুতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা তিনি নির্বাক হওয়ার আগ পর্যন্ত আর ভুলতে পারেন নি। কবিতার আগুনে জ্বালাময়ী লেখায় আর ভরাট গলার টানে যে কবি পুরো বাংলাকে যাদুগ্রস্ত করে মোহময় করে রাখতেন, সেই বিদ্রোহী আর দুরন্ত কবি নজরুলের মমতাময় মনের এমন প্রকাশ দেখে তার বন্ধুরাও নিশ্চুপ হয়ে থাকতেন।

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।