Skip to main content

যে প্রদীপ নিভে গেল


শায়খ আল্লামা সাঈদ রামাদান আল বুতি

কেন তিনি একজন অসাধারণ

তামীম রায়হান





তুর্কিস্তানের এক বৃদ্ধ আলেম। কেউ তার নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি নাম বলেনমোল্লা রামাদান। বাংলায় বলা যায়রমযান মোল্লা। অতি সাধারণ নাম। তার বেশভূষাও সাধারণ। তুরস্কের বুতান নামের ছোট্ট একটি দ্বীপের গ্রামে তার বাড়ী। ১৯৩৩ সালে তিনি সিরিয়ার রাজধানীতে চলে আসেন। কদিন পর পর তিনি নিজের এলাকায় যান। আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করে আসেন। যাওয়ার আগে দামেস্কের রমরমা বাজার থেকে স্বজন ও বন্ধুদের জন্য কিছু উপহার কেনা তার অভ্যাস।


একদিন সন্ধ্যাবেলা। আগামীকাল খুব ভোরে তিনি যাত্রা শুরু করবেন। দামেস্কের বাজার তখনও জমজমাট। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁক ডাকে অস্থির। মোল্লা রামাদান কিছু পোষাক কেনার জন্য বাজারে ঢুকলেন। এক দোকান থেকে তার পছন্দের কিছু জামা-কাপড় কিনলেন।
উসমানী খেলাফতের সময় মানুষ ক্রয় বিক্রয়ে দু ধরণের মুদ্রা ব্যবহার করতো। অল্প দামের কেনাবেচার জন্য সাধারণ ধাতুর মুদ্রা। খুব দামি জিনিসপত্রের জন্য স্বর্ণমুদ্রা। মোল্লা রামাদানের পকেটেও দু ধরণের মুদ্রা। তিনি দুটি আলাদা রুমালে সেগুলো ভরে রেখেছেন। বাজারের ধাক্কাধাক্কিতে তার পকেটে থাকা রুমাল দুটি এলোমেলো হয়ে গেল। স্বর্ণমুদ্রা এবং সাধারণ পয়সা মিলে গেল একসাথে।
দোকানদারের কাছ থেকে জামাগুলো নিয়ে পকেটে হাত দিলেন তিনি। সেখান থেকে মূল্যমানের মুদ্রা বের করে দিলেন। দাম হয়েছিল সাধারণ মুদ্রার সমান। কিন্তু ভুলক্রমে তার হাতে উঠে গেল স্বর্ণমুদ্রা। তিনি তা খেয়াল করেননি। দোকানীর হাতে মুদ্রা দিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন বাজার থেকে। তখনও তিনি জানেন না, কিসের বিনিময়ে কত দামি স্বর্ণমুদ্রা তিনি খুইয়ে এসেছেন। বাজার থেকে বের হয়ে তিনি বাড়ীর দিকে যাচ্ছেন। হেঁটে হেঁটে ধীরলয়ে। হঠাৎ তিনি সালামের শব্দ শুনতে পেলেন। ডানদিকে তাকিয়ে দেখেন, সুন্দর সুদর্শন এক যুবক। তার দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসছে। যুবকটি তাকে বলে উঠলো, শায়খ! কী কী কিনলেন আজকে?
উত্তরের অপেক্ষা না করে যুবকটি তার হাত ধরে ফেলল। মোল্লা রামাদান অবাক হয়ে গেলেন। এ কি! এ কোন যুবক! ডাকাত না তো! আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে! আমি প্রাণটুকু নিয়ে ফিরতে পারবো তো! যুবকটি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল বাজারের দিকে। আবার বাজারের ভেতরে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে সেই দোকানের সামনে। মোল্লা রামাদান অবাক হয়ে নির্বাক হয়ে আছেন।

দোকানটির সামনে গিয়ে দেখেন, দোকানীর হাতে তখনও মুদ্রাটি। এ সুদর্শন অচেনা যুবক দোকানদারকে বলল, শায়খের স্বর্ণমুদ্রা ফিরিয়ে দাও। আর শায়খ! আপনি সাধারণ ধাতুর মুদ্রা থেকে তাকে মূল্য পরিশোধ করুন। ভুলক্রমে তো আপনি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে ফেলেছিলেন তাকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খাচ্ছেন মোল্লা রামাদান। তিনি পকেট থেকে বের করে তার মূল্য দিলেন। এবার যুবকটিকে ধন্যবাদ দেওয়ার পালা। তিনি ডানদিকে তাকালেন, যুবকটি নেই। বামদিকে তাকালেন, কোথায় সে? এখানেও তো নেই। সামনে পেছনে খুঁজতে লাগলেন তিনি। না, কোথাও নেই। ভাবনায় পড়ে গেলেন, মানুষরূপী এ কে? তবে তার দয়াময় মালিক তাকে বাঁচানোর জন্য কোন ফেরেশতাকে পাঠিয়েছিলেন। হয়তো তাই। ঘরে ফিরে মোল্লা রামাদান কৃতজ্ঞতায় কাঁদছেন, শুকরিয়া জানাচ্ছেন তার মাওলাকে।
মানুষের কাছে নিরীহ সূফী হিসেবে পরিচিত এ সাধক মোল্লা রামাদান আমাদের আজকের আলোচিত শায়খ সাঈদের সম্মানিত বাবা। বাবার সততা, পরহেযগারী, দুনিয়াবিমুখতা, ইলমের গভীরতা এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব পূর্ণমাত্রায় প্রভাব ফেলেছিল শায়খ সাঈদের জীবন ও আদর্শে। বাকি জীবন তিনি তার বাবার আদর্শ থেকে সরে যাননি। সাঈদ রামাদান যখন কিশোর বয়স, তখন তার বাবা একদিন তাকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলেন। বাবার হাতে ছেলের হাত ধরা। তিনি তাকে বলছিলেন, সাঈদ, আমি যদি জানতাম যে রাস্তাঘাটের ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করল আল্লাহকে পাওয়া যায়, তবে আমি তোমার জন্য বড় বড় ডাস্টবিন বানিয়ে যেতাম। তোমাকে ঝাড়দার বানাতাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত হয়েছি, আল্লাহকে পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে ইলম। কাজেই বাবা আমার! তুমি ওয়াদা করো, কোনদিন এ ইলম ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাববে না। এ ইলম দুনিয়ার কোন কিছু পাওয়ার জন্য শিখবে না। কিশোর সাঈদ তার বাবার সাথে ওয়াদা করেছিলেন। জীবনভর তিনি সেই ওয়াদার উপর অটল ছিলেন।
পাঠকদের অনেকেই হয়তো ভাবছেন, কে এই শায়খ সাঈদ রামাদান আল বুতি? আমিও ভাবছি, ঠিক কি বলে আপনাদেরকে তার পরিচয় দেয়া যায়?


তিনি সিরিয়ার ঐতিহাসিক মসজিদ জামে বনু উমাইয়ার একজন খতীব। এমন খতীব তো ছড়িয়ে আছে মসজিদে মসজিদে, বিশ্বময়। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এবং শাম অঞ্চলের উলামাদের ঐক্যসংস্থার প্রধান নেতা- এসব তো পদবীর পরিচয়। এমন পদবিধারী নেতা ও আলেমের সংখ্যাও তো আরববিশ্বে কম নয়। তিনি মুফাসসির এবং অনলবর্ষী বক্তা- কিন্তু তাফসীর আর ওয়াজ মাহফিল তো সব অঞ্চলেই হয়। তিনি একজন লেখক এবং গবেষক- না, এটাও তেমন আলাদা কিংবা বিশেষ ব্যক্তিত্বের পরিচয় নয়। তবে কেন তাকে নিয়ে আমার এত ভালোবাসা, তার মৃত্যুসংবাদে এত মনখারাপ হওয়া, তাকে নিজের চোখে না দেখেও কেন রাতভর ইন্টারনেট-ইউটিউবে তার সর্বশেষ সংবাদ জানার জন্য উদগ্রীব জেগে থাকা?

২১ মার্চ, ২০১২। বৃহস্পতিবারের জুমার রাত। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। দেশে চলছে গৃহযুদ্ধ। বিদ্রোহী এবং সরকারী সেনাদলের প্রাণপণ লড়াই। শহেরর সবাই তটস্থ এবং সতর্ক। যে কোন সময় যে কোন জায়গায় বোমা বিস্ফোরন। প্রাণহানি ও আহতদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে উঠে আকাশ বাতাস।
এমন ভয়াবহ দুঃসময়েও ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না তার। আল্লাহর ঘর মসজিদে ইলমে নববীর মজলিস ছাড়া অন্য কিছু তাকে আকর্ষণ করে না। তিনি বেরিয়ে পড়লেন বাসা থেকে। দামেস্কের একটি প্রাচীন মহল্লার পুরনো বাড়ি। চলে গেলেনে দামেস্কের উত্তরনগরী মাজরায়। ওখানের স্থানীয় মানুষ এবং ছাত্রদের জন্য সপ্তাহে দুবার তিনি দরস দেয়ার জন্য উপস্থিত থাকেন। আজকে তো বৃহস্পতিবার। বাইরের পরিস্থিতি যা-ই হোক, সেসব তো আর ইলমের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি রওয়ানা হলেন। যথাসময়ে সেখানে গিয়ে এশার নামাজের পর বয়ান শুরু করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত আতংকের নগরী মাজরায় সেই ছোট মসজিদটিতে উপস্থিত হয়েছেন প্রায় দেড়শ মানুষ।
মসজিদের নাম মসজিদুল ঈমান। ভেতরে তিনি বসে আছেন চেয়ারে। তার সামনে টেবিল। তাতে রাখা কুরআন শরীফ। তিনি আল্লাহর কালাম থেকে তাফসীর করে শোনাচ্ছেন উপস্থিত বান্দাদেরকে। এ কাজ করে করেই তো পার করে দিলেন জীবনের ৮৪ বছর। কুরআনের ছোঁয়ায় বার্ধক্যের দুর্বলতা আর শারীরিক অক্ষমতার সব ক্লান্তি তিনি ভুলে যান। মানুষকে শেখান দ্বীনের কথা। রাসূলের কথা। 
আল্লাহর ঘর মসজিদের মিহরাবের কাছে পবিত্র জুমার রাতের বরকতময় প্রহরে কেঁপে উঠল মসজিদ। বিকট শব্দের বিস্ফোরণ। আর্তচিৎকার। কিয়ামতের বিভীষিকা নেমে এল খোদার পবিত্র গৃহে। চেয়ারের একপাশে লুটিয়ে পড়লেন এ সময়ের একজন আল্লাহপ্রেমিক সাধক পুরুষ। তিনি গড়িয়ে পড়লেন। আল্লাহর মসজিদ থেকে তার অন্তিমযাত্রা শুরু হল ঘরওয়ালার দরবারে। মসজিদুল ঈমানের ভেতর ইলম ও ঈমানের সুরভিত পরিবেশ তাকে বিদায় জানালো। রাতের কালোপ্রহরে হারিয়ে গেলেন একজন অনন্য পুরুষ। সময়ের কারো সাথে যার উদাহরণ দিয়ে তুলনা করা যায় না।

রক্তের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে মসজিদ। ঝরে গেল ৪৯ জন ছাত্র ও আল্লাহভক্ত বান্দাদের প্রাণ। আহত হয়ে কাতরাচ্ছে আরও শ খানেক শ্রোতা মুসলমান। খবর ছড়িয়ে পড়েছে দামেস্কে, সিরিয়ায়। সারা আরব পৃথিবীতে, গোটা দুনিয়ায়। এক শক্তিশালী আত্মঘাতি বোমা হামলায় শহীদ হয়েছেন শায়খ আল্লামা ডক্টর সাঈদ রামাযান আল বুতি। ২২ শে মার্চ ২০১২। মাত্র একলাইনের সংবাদে শোকস্তব্ধ হয়ে গেল আরব-অনারব দুনিয়ার অজস্র আলেম, গবেষক, ছাত্র এবং সাধারণ মুসলমান।
তার মৃত্যুসংবাদ আরবপৃথিবীর সবগুলো গণমাধ্যমে শীর্ষসংবাদ হয়েছে। তার কট্টর সমালোচকরাও এ হীন আক্রমণের নিন্দা করেছেন। তার মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত শুধু ইউটিউবে তাকে নিয়ে আপলোড করা হয়েছে শ শ ভিডিও। সিরিয়ার সরকার এর প্রতিশোধ নেয়ার দীপ্ত ঘোষণা দিয়েছে। বিদ্রোহী নেতারাও এ হামলায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। একে অপরকে দোষ চাপাচ্ছে তারা। এর ভেতর দিয়েই প্রমাণ হয়, বিপক্ষ ও বিরোধী মতের হয়েও তিনি ছিলেন আরবপৃথিবীর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন নিন্দা জানিয়েছেন এ বর্বরতার। রাজনৈতিক কারণে যারা তার সমালোচনা করছিলেন এতদিন, তারাও এ হত্যাকান্ডে স্তব্ধ। তার মৃত্যুতে আনন্দিত হয়ে নিজেদেরকে নির্বোধ কিংবা মূর্খ পরিচয় দিয়ে নিন্দা ও কলঙ্কের ভার নিতে চাচ্ছেনা তার রাজনৈতিক শত্ররাও। তার জানাযা থেকে নিয়ে দাফন পর্যন্ত কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করেছিল সিরিয়ার সরকারী টেলিভিশন, আল জাজিরাসহ অন্যান্য চ্যানেলগুলো।
তার সবচেয়ে সাধারণ এবং অসাধারণ পরিচয়- তিনি একজন আলেমএটাই তার প্রথম এবং শেষ পরিচয়। যে কেউ তার লিখিত একটি পৃষ্ঠাও জীবনে পড়েছে- সে তার অজান্তে মুখ ফুটে বলে উঠবে, এই হলো ইলম। আমিই যে এর সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রমান। তার বক্তৃতা ও বয়ান যে শুনেছে, সে বিস্ময়ে চোখ বড় করে বলেছে, এই তো আলেম। শুধু ইলমের বাহাদুরিতে নয়, তিনি আমার মতো অনেক অজস্র আরব-অনারব, ছাত্র কিংবা আলেমকে মোহিত করে রেখেছিলেন কিছু অন্য কারণে। যে কারণগুলো খুব সহজে কেউ শিখে নিতে পারে না, চাইলেই নিজের ভেতর ধারণ করা যায় না।

খুব সাধারণভাবেই আমার কথা দিয়ে শুরু করি। নিজস্ব অধ্যয়নের তালিকায় যে বিষয়গুলো আমার খুব পছন্দের- সেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস হিসেবে পড়ার পর আমার অনুভূতি উল্টে যায়। ভালোলাগার বিষয় কিংবা গ্রন্থটি তখন পরীক্ষার চিন্তা ও অস্থিরতায় বিরক্তির জন্ম দেয়। গত বছরের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসভুক্ত নবী সা. এর সীরাতসংশ্লিষ্ট একটি বিষয় পড়ার জন্য ক্লাসে হাজির হলাম। প্রফেসরের ভাব ব্যবহার প্রথমদিনই আমাকে হতাশ করে দিল। আঞ্চলিক আরবী লেকচার, তার সাথে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা এবং একটু পর পর হিহি করে হাসি- কি অদ্ভুত এই শিক্ষক। তখন থেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম এ ক্লাস এবং ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে। একসময় পরীক্ষা চলে এল। এবার তো পড়তেই হবে। অনেক বইয়ের নীচে চাপা পড়ে থাকা বইটি বের করে ধুলোবালি মুছে হাতে নিলাম। মনের মেজাজে অমনোযোগী এবং চেহারায় অবহেলা নিয়েই পড়তে বসলাম।
কিন্তু! আমি যেন চলে গেলাম এক নতুন ও ভিন্ন জগতে। বিষয় তো পুরনো, নবীর জীবন এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য। কতবার কত কত কিতাবে সেসব আমি পড়েছি। কিন্তু! এভাবে এসব লেখা যায়! এমন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ভঙ্গিমায়, গভীর চিন্তা ও গবেষণা থেকে বের করা তথ্যগুলোর কোমল উপস্থাপনা করে এভাবে লেখা যায়! আমার মতো অভাজনকে বইটি জড়িয়ে নিলো এর ভেতর লুকিয়ে থাকা আকর্ষণের মায়াজালে। ফিকহুস সীরাহ নামের ঐ কিতাব কার লেখা! তিনি কে! কী তার পরিচয়! আমি তন্ময় হয়ে খুঁজলাম। তাকে পেয়ে গেলাম ইন্টারনেটে ইউটিউবে। তার কন্ঠ শুনতে পেলাম, তার চেহারা দেখে নিলাম। বিরক্তের বিষয়টি হয়ে উঠলো আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নির্ধারিত অংশের চেয়েও বেশি পড়ে ফেললাম। বারবার মনে হচ্ছিল, তিনি যেন আমার জন্যই লিখেছেন তার লেখা। একই অনুভব আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল তার অন্যান্য কয়েকটি কিতাব পড়ার সময়ও।
বছর শেষে দেশে ফেরার সময় কিতাবটি নিয়ে গেলাম হযরত মুফতি আমিনী রহ. এর জন্য। পরের দিনই তিনি আমাকে ডাকালেন। নিজে পাতা উল্টিয়ে পড়ে শোনালেন নানা জায়গা থেকে। তিনি পড়ে শোনাচ্ছেন, আমি তাকিয়ে দেখি, তিনি কাঁদছেন। নবীকে নিয়ে এভাবে লেখা যায়!

ছাত্রজীবন থেকে কিতাবপত্রের নেশায় আসক্ত হযরত মুফতি আমিনী বারবার সেই কিতাবটি পড়েছেন। কেঁদেছেন। কি জানি, এজন্যই কি তিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতে ফিকহুস সীরাহ এর সাথে মিলিয়ে মাআরিফুস সীরাহ নামে আরবীতে নবীজীবনী লেখার কাজ শুরু করেছিলেন? শায়খের লেখা আরেকটি কিতাব পড়ে অবাক বিস্ময়ে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন মুফতি আমিনী। একবার শেষ করে আরেকবার, তারপর আবার। তিনি কয়েকবার পড়েছেন। তাতেও তার ঘোর কাটেনি, তিনি মাদরাসার কয়েকজন আলেমকে ডেকে নিজে পড়ে শুনিয়েছেন। আমাকে ডেকে বলেছিলেন, আরবে এমন আলেম এখনও আছে, আমি জানতাম না। কি আজিব লেখা লিখছেন উনি।
তারপর কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখে ফেললেন সুদূর সিরিয়ার এ শায়খকে। সেই চিঠি কপি করালেন আমাকে দিয়ে। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, আমি আপনাকে অন্তর থেকে আমার মুরব্বী হিসেবে গ্রহণ করে ফেলেছি। আপনার কিতাব আমার অনেক দিনের জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর খুলে দিয়েছে। শায়খ বুতির ভিডিও আমার কাছে আছে-  এ শুনে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। পরের দিনই আমাকে আসতে বললেন। ল্যাপটপে শায়খের বয়ান শুনেছেন। কয়েক ঘন্টা ধরে। আবারও আরেকদিন তিনি ডেকেছিলেন। ল্যাপটপের পর্দায় তিনি তাকিয়ে ছিলেন শায়খের দিকে। তন্ময় হয়ে শুনেছেন তার কিছু দরস ও বয়ান। আমাকে দিয়ে তার  আরও কয়েকটি লেখা কিতাব সংগ্রহ করেছেন। সেসব পড়েছেন। হযরত মুফতি আমিনী রহ. এর মৃত্যুর পর তার একান্ত পড়াশোনার রুমে গিয়ে দেখি, আমার দেয়া শায়খের কিতাবগুলোর পাতায় পাতায় গুরুত্বপূর্ণ অংশ দাগ দিয়ে রেখেছেন। পাতায় পাতায় নোট লিখেছেন।


এ জীবনে আলেম দেখার সুযোগ অনেক হয়েছে। ইলমের তাপে উত্তপ্ত বক্তৃতা বয়ান শুনেছি অনেকবার। কিন্তু শায়খ বুতির মতো আর কেউ আমাকে আকর্ষন করেনি। বিশুদ্ধ আরবীর কি প্রাঞ্জল উপস্থাপনা, মানুষের জন্য মায়া ও আবেগমেশানো তার গম্ভীর কন্ঠস্বর, গাম্ভীর্যভরা চেহারার প্রকাশ এবং কথার মাঝে মাঝে হাত নাড়ানোর সেকি এক অন্যরকম সৃজনশীল অঙ্গভঙ্গি, ঘন্টার পর ঘন্টা তন্ময় হয়ে মানুষ শুনছে তার কথামালা। তার সাধারণ এবং নিয়মিত অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক দরসগুলোতে সমবেত হতো কমপক্ষে চার হাজার শ্রোতা- যাদের অধিকাংশ আলেম ও তালেবুল ইলম। পাঁচ-দশহাজার অতিথির সুধিসম্মেলন কিংবা ছোট্ট কোন মসজিদের শ দুয়েকের মজলিস- তিনি সবসময় একরকম। সেই একই ভাষা, একই মুগ্ধতা। ইন্টারনেটে-ইউটিউবে সেগুলোর দর্শকসংখ্যা লাখ লাখ মানুষ।
জীবনের শেষদিনগুলোতে তিনি সিরিয়ার ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন। বলতেই পারেন। তার মতো গবেষকের নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং কর্মপদ্ধতি থাকতেই পারে। মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে আবেগ উত্তেজনায় ভেসে যাওয়ার মতো মানুষ তিনি নন। তিনি যা বুঝেছেন, চিন্তাভাবনা করে যে মত দিয়েছেন, তা থেকে কেউ তাকে টলাতে পারবে না। ক্ষণে ক্ষণে সুর পাল্টিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য তিনি লালায়িত নন। সম্পদ কিংবা রাষ্ট্রীয় পদবীর সামান্য ইচ্ছাও তাকে কখনো কলুষিত করেনি। তার বিশ্বাস ও জ্ঞান অনুযায়ী, মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা যাবে না, যতক্ষণ সে কুফুরী মতবাদ গ্রহণ না করে। সিরিয়ায় সংঘাতে সূচনা করেছে একদল তরুণ। যারা লিবিয়া এবং মিসরের বিপ্লব দেখে রাস্তায় নেমে এসেছিল। ঠিক কী কারণে তারা সরকারের বিরুদ্ধে- এর উত্তরে এমন কোন উত্তর খুঁজে পাননি শায়খ- যা তাকে সরকারের বিপক্ষে যেতে বাধ্য করবে। তিনি তাই বলেছেন, শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র নয়। আমরা তাওহীদে বিশ্বাসী সবাই মুসলমান। বাইরের শত্ররা এ জঘন্য খেলার জন্য উস্কানী দিচ্ছে। শাসকের সাথে আলোচনা কিংবা সমঝোতার পথ তো বন্ধ হয়নি, কেন তোমরা হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছো? মুসলমানদের মধ্যে এ কোন সংঘাতের শুরু হল। সিরিয়ার রাজনৈতিক সংঘাতে শায়খ বুতির এ অবস্থান অনেককেই অবাক করেছে। আমৃত্যু তিনি নিজের ইজতেহাদের উপর অটল ছিলেন।

সহিংস এবং সংঘাতে বিপর্যস্ত দামেস্কের এখানে ওখানে নিয়মিত দরস দিতেন। সাপ্তাহিক বয়ান করতেন। তার বয়ান, তার খুতবা সর্বসাধারণের হাসি-কান্নার জন্য নয়। প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি বাক্য তার সুচিন্তিত ও গোছালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বক্তৃতা এবং মসজিদের মিম্বার থেকে তার বয়ান- একই উচ্চমান, একই ভাব ও ভঙ্গিমার বয়ান। দরস ও বয়ানের শেষে তিনি কাঁদতেন। সিরিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতেন। সেইসব ফরিয়াদের হৃদয়ছোঁয়া শব্দমালা এবং কান্নার সুর এখনো বাজছে ইউটিউবের অজস্র ভিডিওতে।


তিনি তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন সাধারণ সাদামাটায়। তার ছাত্রের চেয়েও অধম অনেক সাধারণ আলেম কিংবা বক্তা ইসলামের নামে বড় বড় পদবী পেয়েছেন, ধন-সম্পদে সমাজের হর্তাকর্তা হয়েছেন। অথচ তিনি! সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ শুধু নয়, বাশার আল আসাদের বাবা হাফেজ আল আসাদও এ শায়খকে সম্মান করতেন। শ্রদ্ধা জানাতেন। ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুর এত শ্রদ্ধেয় হওয়ার পরও তিনি বাস করতেন প্রাচীন একটি বাড়িতে। চারতলায়। ৮৪ বছর বয়সের বৃদ্ধ হয়েও তিনি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতেন। চাইলে তিনি, চাওয়া নয়, সামান্য ইঙ্গিতে পেয়ে যেতেন দামেস্কের অভিজাত এলাকায় নিরাপত্তায় ঘেরা সুবিশাল বসতবাড়ি। এখানেই তার সাথে অন্য সব আলেম ও শায়খদের পার্থক্য। সিরিয়ার ধর্মমন্ত্রী হওয়ার জন্য অনেকবার তার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, তিনি সাথে সাথে আমার দরকার নেই বলে ফেরত পাঠিয়েছেন।

শাসকদের কাছে তিনি শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র ছিলেন। তাই বলে নতজানু হননি। আরববিশ্বের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ আলেম ও শায়খ হওয়ার পরও তার বিনয় ছিল প্রবাদবাক্যের মতো। তার সমসাময়িক অন্য উলামায়ে কেরাম এবং তার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ছাত্ররাও বলতো, তিনি পূর্বসুরীদের রয়ে যাওয়া রতœ এ মানুষটি আজকের যুগের নয়। নইলে প্রজ্ঞা ও ইলমের আভিজাত্যের সাথে এমন নির্মোহ চরিত্র এত বিনয়ী ব্যবহার কীভাবে সম্ভব আজকের দুনিয়ায়!!


সংক্ষিপ্ত জীবনতথ্য- শায়খ সাঈদ রামাদান এর জন্ম ১৯২৯ সালে। ১৯৩৩ চার বছর বয়সে তিনি বাবার সাথে দামেশকে চলে আসেন। ছয় বছর বয়সে পবিত্র কুরআন হিফয করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি তার মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। ছাত্রজীবনে তিনি সর্বশেষ মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছিলেন ১৯৬৫ সালে। আরবী এবং কুর্দি ছাড়াও তিনি ইংরেজী ভাষা চর্চা করতেন। ১৯৯১ সালে তিনি ফ্রান্সে অবস্থিত ইউরোপিয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে ইসলামে সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে ঐতিহাসিক বক্তব্য দিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি দুবাই আর্ন্তজাতিক সম্মাননায় শ্রেষ্ঠ ইসলামিক ব্যক্তিত্বের সম্মান লাভ করেছিলেন। ২০১২ সালে শ্রেষ্ঠ ৫০০ জন মুসলিম মনিষীদের তালিকায় তার অবস্থান ছিল ২৭তম। অক্সফোর্ডের উচ্চপরিষদের সদস্যসহ তিনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা সংস্থার বিভিন্ন পদের অধিকারী ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০ টি। পবিত্র কুরআনের পূর্ণ তাফসীর, তাসাউউফ শাস্ত্রের বিভিন্ন জটিল কিতাবের ব্যাখ্যাসহ তার অনেক অডিও-ভিডিও বয়ান ইন্টারনেটে লাখ লাখ শ্রোতাদর্শককে বিমুগ্ধ করে রেখেছিল।


আজ ২৩ মার্চ. ২০১২। শনিবার, বিকাল ৪টা। যখন এ লেখাটি লিখছি, এ মহান শায়খ আল্লামা সাঈদ রামাযান আল বুতির শাহাদাতের সৌভাগ্যমন্ডিত নিথর দেহ চিরশয্যায় শায়িত করা হচ্ছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের মসজিদে বনু উমাইয়া আল কাবীরের পেছনে মুসলিম ইতিহাসের অনন্য বীর শহীদ সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর কবরের পাশে। কি সৌভাগ্য, কি সম্মান!!

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

যে বার্তা রেখে গেলেন মুফতী আমিনী উবায়দুর রহমান খান নদভী জীবন যেভাবে যাপন করবে মৃত্যুও তোমাদের সেভাবেই হবে। যেভাবে মৃত্যুবরণ করবে শেষ বিচারের দিন সে অবস্থায়ই উঠবে। জীবন- মৃত্যুর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন একটা ইশারা রয়েছে। মুফতী মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ১১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিনভর তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করেছেন। ইবাদত-বন্দেগী , খাওয়া দাওয়া , শিক্ষকতা ও ইমামতিসহ সংগঠন , রাজনীতি , বৈঠক , বিবৃতিদান সবই করেছেন। রাতের মাগরিবের পর থেকে এশা পর্যন্ত লালবাগের ছাত্রদের বোখারী শরীফ পাঠদান করেছেন। একবার বলেছিলেন শরীর খারাপ লাগছে। ১১টার দিকে বেশি খারাপ লাগায় হাসপাতালে যান। সেখানেই রাত সোয়া বারটার দিকে তার ইন্তেকাল হয়। তারিখটা পড়ে যায় ১২ ডিসেম্বর। বহুল আলোচিত ১২-১২-১২ তারিখ মুফতী আমিনী চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!