আমাদের বাংলা ভাষা ও কিছু কথা
তানিম সিদ্দিকী
আমরা বাংলায় কথা বলি। মনের ভাব বাংলায় প্রকাশ করি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। কষ্ট করে আমাদের এ ভাষা শিখতে হয়নি। মায়ের কোলে বসে থেকেই আমরা এ ভাষা শিখে ফেলেছি।
বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা, প্রাণের ভাষা। পৃথিবীতে হাজারো ভাষা আছে। তবু বাংলাভাষাই আমাদের কাছে প্রিয়। সবচে দামী। জীবনের প্রয়োজনে নানা ভাষা আমাদেরকে শিখতে হয়। আরবী, ইংরেজী, উর্দূ যে কোন ভাষাই হোক মনে মনে আমরা কিন্তু বাংলায়ই বুঝি। আমাদের হৃদয়ের গভীরে মিশে আছে এ ভাষা। কখনোই তা ভোলা সম্ভব নয়। বিশ্বসভায় আমাদের বাংলা ভাষার আলাদা মর্যাদা রয়েছে। পৃথিবীতে অন্য কোন ভাষার তা নেই। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে পেয়েছি রক্তের বিনিময়ে। পৃথিবীতে সকল ভাষার মাঝে তাই বাংলা ভাষার আলাদা কদর রয়েছে। বাংলা ভাষার সম্মানেই ২১শে ফেব্র“য়ারীকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
তবু দুঃখের সাথে বলতে হয়, বাংলা ভাষা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। ইংরেজীর আগ্রাসনে বাঙালীদের মুখ থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষা। বাংলার চেয়ে ইংরেজীকে এখন মানুষ বেশি পছন্দ করে। কেউ ভালো ইংরেজী জানলে চাকরিটা তাকেই দেয়া হয়। ভালো বাংলা জানলে তার কোন মূল্যই হয়না। এখনকার আধুনিক মা-বাবা সন্তানকে বাংলা শেখানোকে ইংরেজী শেখাতেই বেশি আগ্রহী।
জানি, অনেকেই বলবেন এ যুগে ইংরেজীর অনেক বেশি প্রয়োজন। আমরা এটা অস্বীকার করি না। শুধু বলবো, মাতৃভাষার মর্যাদা কি তার চেয়েও বেশি নয়! তাছাড়া ইংরেজী শেখার প্রয়োজন আছে ঠিক কিন্তু চলন ও বলনে ইংরেজ হবার তো প্রয়োজন নেই।
এখন তো ছেলে-মেয়েদের কথায় বাংলা শব্দের চেয়ে ইংরেজীরই প্রাধান্য থাকে। বাঙালীদের কথা শুনে তো মনেই হয় না যে বাঙালী। উল্টো বরং মনে হয় কোনো ইংরেজ বাংলা শেখার চেষ্টা করছে। কথায় কথায় ইংরেজী বলাকে আভিজাত্য এবং শিক্ষিতের প্রতীক মনে করা হয়। আর বাংলাকে মনে করা হয় গেয়ো ও মূর্খ মানুষের ভাষা।
অবাক লাগে এদেশের আলিম সমাজ যারা এক সময় ব্রিটিশদের আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য ইংরেজীকে হারাম বলে ঘোষণা করেছিলেন তাদের অনেকেও এখন ইংরেজী অনেক তৃপ্তির সাথে উচ্চারণ করেন। ওয়াজ মাহফিলে কিংবা মসজিদের মিম্বরে যখন কাউকে দেখি বিনা প্রয়োজনে বাক্যের ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজী শব্দ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন- তখন আশ্চর্য না হয়ে পারি না।
আমি জানি, আমার এ লেখাটি পড়ে অনেকেই ভ্রু কুঞ্চিত করবেন। আমি বলব, তারা আমার বক্তব্য ঠিকমত বুঝেননি। আমি এই লেখার মাধ্যমে ইংরেজী ভাষার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছি- এমন নয়। বরং বাংলা ভাষার উপর ইংরেজীর আক্রমণ হচ্ছে বলেই আমি ইংরেজীর কথা বলেছি। যদি ইংরেজীর স্থানে অন্য কোন ভাষা হতো তাহলে আমি সেই ভাষার কথাই বলতাম।
ইংরেজীর প্রতি বিদ্বেষ আমার নেই। কারণ, সব ভাষা আল্লাহর দান, আল্লাহর সৃষ্টি নেয়ামত। কোনো নেয়ামতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার মত দুঃসাহস আমার নেই। কোনো ভাষা কখনোই মন্দ নয় কিংবা কম মর্যাদার নয়। তবে প্রত্যেক ভাষাভাষীর জন্য তার নিজের ভাষাই সবচে’ শ্রেষ্ঠ। কারণ সৃষ্টিকর্তা তাকে সেই ভাষা দান করেছেন। তাই মাতৃভাষার ওপরে অন্য কোন ভাষাকে প্রাধান্য দেয়া হতে আল্লাহর নেয়ামতের সাথে ধৃষ্টতা প্রদর্শন।
হ্যাঁ, অন্য কোন ভাষা শেখা কখনোই দোষের নয় বরং তা অনেক প্রশংসনীয়। প্রয়োজনে মানুষ যে কোন ভাষা শিখতে পারে এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এজন্য কাউকে নিন্দা করা যাবে না। বরং নিন্দা তখনই করা হবে যদি সে মাতৃভাষাকে ঘৃণা করে অথবা মাতৃভাষার বদলে প্রয়োজন ছাড়াই বিদেশী ভাষা ব্যবহার করে। শুধু ইংরেজীই নয়, যারা একইভাবে হিন্দি, উর্দূ বা ফারসী যে ভাষাই হোক ব্যবহার করেন আমি তাদেরকেও একই কথা বলবো।
আরবী কিংবা ইংরেজী- যে ভাষায়ই আমরা পড়াশোনা করি না কেন, সবকিছুকে ধারণ করতে হবে বাংলায়। মানুষকে তা জানাতে হবে বাংলায়। কাজেই শুধু একটি নির্দিষ্ট মাসকে কেন্দ্র করে ভাষার জন্য দরদ দেখানো নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষণে বাংলার বিশুদ্ধ ব্যবহার আমাদের সচেতনতার দাবী।