মুফতি আমিনী রহ.- মনের অব্যক্ত বেদনা
- আসাদুল্লাহ -
পৃথিবীর চলমান সময়ের খাতায় ২০১২ সাল একটি স্বাভাবিক বছর।
প্রতিটি বছর ফুরালেই শুরু হয় মানুষের নানান হিসাব। কি পেলাম আর কি হারালাম। আর সে
হিসাবে এ স্বাভাবিক বছরটিতে আমি পাওয়ার চেয়ে হারালামই অনেক বেশি। আর তাই এসব
কারণে ২০১২ সালটি আমার হৃদয়ের খাতায় অস্বাভাবিক হয়ে থাকল।
গত ২৪ আগস্ট ২০১২ তে পরম মমতাময়ী মাকে হারিয়েছি। ‘মাকে হারানোর কষ্ট কেমন হয় তা
কেউ কখনো বুঝাতে পারবে না। যার হারিয়েছে শুধু সেই বলতে পারবে।’ এমন কথা শুনেছি অনেকের কাছ থেকে। কিন্তু নিজেই এতদ্রুত
বুঝতে পারবো তা কখনো ভাবিনি। মায়ের মমতাভরা সে ডাক আর কখনো শুনব না একথা ভাবতেই
বারবার চোখে পানি এসে যায়, তবুও তা মেনে নিতে হয়। কারণ জীবন ও মরণের এ অলিখিত বিধান
সকলকেই মেনে নেতেই হয়। যাই হোক, আজ বসেছি আমার উস্তাদ ও শাইখের স্মৃতি চারণ করতে।
ছোট বেলা থেকেই আমি ছিলাম দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে। সে কারণেই মাত্র ৮ বছর বয়সে
মা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন আমার শ্রদ্ধেয় বড়ভাই এর কাছে। তিনি ঢাকার একটি নামকরা
মাদ্রাসার শিক্ষক। তাঁর সুবাদে ভর্তি হলাম সে মাদ্রাসায়। প্রতিষ্ঠানটি বড় হওয়ার
সুবাদে দেখতে পেয়েছি আমাদের অনেক নামকরা দেশী-বিদেশী আকাবিরদের, দেখেছি মুফতী
আমিনী সাহেব রহ. কেও। শুনেছি তাঁর পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা। তবে বিপক্ষেই শুনেছি
বেশি। কারণ প্রতিষ্ঠানটি ছিল হুযুরের বিরোধী এবং তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তাই
ছিল। জানিনা হুযুর সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থা কি? তবে শুনেছি
হুযুরের জানাযার দিন প্রতিষ্ঠানটির ক্লাশ বন্ধ ছিল, হয়তো
ছাত্রদের আবেগের কারণে কিংবা মৃত ব্যক্তির কথা ভেবে!
গত এক দেড় বছর আগের কথা। সেখানের কোন একটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেয়ে তাতে
অংশগ্রহণের জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। আমার তখনকার একজন উসতাদের সাথে দেখা হলো, বিভিন্ন
বিষয়ে কথা বলার পর জানতে চাইলেন আমার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। আমি বললাম, লালবাগে মুফতী
আমিনী সাহেবের ছায়ায় আছি। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘ও মুফতী আমিনীর চামচামী করস্!’। কথাটি শুনে আমি চুপ হয়ে অন্য কাজের বাহানা দিয়ে সেখান
থেকে চলে এলাম। আমার ঐ হুজুরের কথায় মোটেও রাগ করিনি। কারণ তার সম্পর্কে আমার খুব
বেশি জানার প্রয়োজন না থাকলেও আমার চোখে দেখা তার একটি দৃশ্য আমি তখনও ভুলিনি।
মাদ্রাসার এক অনুষ্ঠান শেষে সবাই যখন বের হচ্ছিল তখন তিনি এক কোটিপতির জুতা এগিয়ে
দিচ্ছিলেন তার পায়ের কাছে। তা দেখে নিজেদের খুব ছোট মনে হল, এই বুঝি
আমাদের শিক্ষা? কোথায় আলেমের মূল্য আর কোথায় কোটিপতির? সেই তিনিই
আমাকে বললেন, আমি মুফতী আমিনীর চামচা। তাকে খুব বলতে ইচ্ছে করেছিলÑ আমিতো একজন
আলেম এবং রাহবারের চামচা। আর আপনি তো একজন
কোটি পতির জুতাবাহী খাদেম। লজ্জা কার?
যাই হোক, হুযুরের বিরুদ্ধে নানা ধরণের কথা শোনার পর থেকেই আমি
প্রায়ই ভাবতাম, এ মানুষটি যদি এতই খারাপা তবে আল্লাহ তাঁকে আকাবিরদের
প্রতিষ্ঠিত ‘লালবাগ
মাদ্রাসা’র মত একটি দ্বীনি মারকাযের প্রধান কেন বানাবেন? তার দ্বারা
ইসলামের এত খেদমত কেন করাবেন? এ ছিল একান্তই আমার মনের ভাবনা।
সবে মাত্র মক্তবের গণ্ডি পেরিয়ে কিতাব খানায় দ্বিতীয় ক্লাশে পড়ছি। একদিন
পত্রিকার পাতায় দেখি ‘হাইকোর্টের রায়ে ফতোয়া নিষিদ্ধ’। দেশে তখন শুরু হলো ইসলামের নতুন এক সংকট। দেশের র্শীষ আলেমদের
বৈঠক হল। সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে একটি মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হলো, যা ২০০১ সালের
২রা ফেব্র“য়ারী অনুষ্ঠিত হয়। পল্টনের সে মহাসমাবেশ থেকে পরের দিন
হরতালের ঘোষণা দেন তিনি। সে ঈমানী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বি-বাড়িয়ায় ৬ জন
শহীদসহ সারা দেশে গ্রেফতার হয় কয়েক শ ছাত্র জনতা। সেই ঐতিহাসিক হরতাল সফল করার
জন্য সেদিন আমিও রাস্তায় নেমেছিলাম।
তখন থেকে হুযুর সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। মনে মনে ভাবি, তাকে কাছ থেকে
দীর্ঘ সময় দেখেছে এমন কাউকে পেলে তার কাছ থেকে একটু ভাল করে জেনে নিব। এ ভাবনাটি
মনে রেখেই কেটে যায় আরও চার বছর।
২০০৬ সালে আমার বন্ধু তামীম রায়হান ভর্তি হয় লালবাগ জামেয়ার মেশকাত জামাতে।
সেই সুবাদে মাঝে মাঝে লালবাগ মাদরাসায় আসা-যাওয়া শুরু। দাওরা হাদীসের বছর দু’চার দিন
হুযুরের বুখারীর তাকরীরও শোনার তাওফিক হয়েছে। তার কাছ থেকেই জানতে পারি হুযুরের
অনেক ঘটনা। সব শুনে হুযুরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি এবং আবেগ ও ভালোবাসা আরও বেশি
বেড়ে গিয়েছিল। ফরিদাবাদ থেকে দাওরা পড়ার পর লালবাগ মাদরাসায় এসে ভর্তি হলাম।
ইফতার ক্লাসে আমি সরাসরি মুফতি আমিনী রহ. এর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য পেলাম। আমরা
ইফতার ছাত্ররা মুফতি আমিনী রহ, এর কাছে উসূলে ইফতা পড়েছি। ঐ বছর পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি
আমাদেরকে বিভিন্নভাবে উপদেশ দিতেন।
পড়ালেখা শেষে হুযুরের ছায়ায় থেকে যাওয়ার ইচ্ছায় লালবাগ আর কখনো ছেড়ে যাইনি।
কোনো না কোনো কারণে এখানেই থেকেছি। হুযুরকে দেখলেই মনের মধ্যে একটা শান্তি অনুভব
হত। মনে সাহস হতো।
এখন তিনি নেই। চলে গেছেন মহান রবের ডাকে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে না ফেরার দেশে। মুফতি আমিনী রহ. এর
শূন্যতায় লালবাগ মাদরাসার এত বড় বড় দালান আর সুরম্য মসজিদকে বড় প্রাণহীন মনে
হয় আমার। তাই আর যেতেও ইচ্ছে করে না লালবাগ জামেয়ায়। আমার পরিচিতজনদের অনেকেই
প্রশ্ন করেন. কি ব্যাপার! তোমাকে তো এখন আর দেখিনা। আসো না কেন? মনের ভেতর
লুকিয়ে থাকা বেদনাময় সত্যকে আড়াল করে বলি, হাতে কাজ বেশি, তাই আসা হয় না।’