বদল
আমিন আশরাফ
মধ্যরাত। নীরব, নিঝুম। অপার পদ-জনপদ ঘুমে আচ্ছন্ন। শ্রান্ত কান্তিময় প্রকৃতির রূপচর্চা চলছে বেশ আরামে-আয়েশে। তৃপ্ত শরীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, বুক উদোম করে।
লোকালয় ছেড়ে মাইলপাঁচেক দূরে মুখে কুলুপআটা দিগন্ত প্রসারী প্রান্তর। সহজ-সরল নিঝুম প্রান্তরের চোখে নেই ঘুম; ঘুমাবেই বা কী করে! বুকের ওপর দাঁড়িয়ে ভয়ংকর অট্টহাসি মেরে চলে গেছে দীর্ঘ একটা দানবসড়ক। তার পাশে পর পর বেশ ফাঁক রেখে বসে আছে ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়ও। জোছনার আলোয় আলোয় মুগ্ধতার শিহরণ। সঙ্গে শরীর জুড়ানো মাতাল হাওয়া। মনে আমেজ তোলা মৃদু বাতাসের আলোড়ন। নিশিজাগা পাখিরা এখানে থাকলে উপরে চেয়ে চেয়ে এই সুখজড়ানো নির্মল পরিবেশে নিঃশ্বাস ফেলতে পিছপা হতো না।
একটু পর পর সড়কের বুক দিয়ে শা-শা করে চলে যাচ্ছে মালবাহী ট্রাক। এ সময় ৫/৬ জনের একটি ডাকাতদলের ২টি মোটর সাইকেল এসে থামলো। হেডলাইটের আলো আর কান ঝালাপালা করা শব্দে ঝোঁপে থাকা পাখিরা ভয়ে ডানা মেললো।
এমন সময় দৃষ্টির শেষ সীমায় একটি গাড়ির আলো দেখতে পেলো ডাকাতদলের ছোকড়াগুলো। চকিত সজাগ হয়ে গেলো যেনো দলটি। দলের একজন কালো মুখোশপরা লোকটিকে বললো, উস্তাদ রেডি হবো?
ওস্তাদ নিজের মোটর সাইকেল চালু করলো। আগুয়ান গাড়িটি ওদের সামনে আসতে আসতে একটি নোয়াহ গাড়িতে রূপ নিলো। ডাকাতদলের হাতে ততোক্ষণে উঠে এসেছে ধারালো দেশি অস্ত্র। চাঁদের আলোতে অস্ত্রগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠছিলো। রাস্তা ব্লক করে দাঁড়িয়ে গাড়ির ড্রাইভারকে থামতে ইশারা করলো।
ততোক্ষণে গাড়ির ড্রাইভার ও তার আরোহীরা বুঝে গেছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। তারা এখন ডাকাতদের খপ্পরে; ভয়ে ড্রাইভার গাড়িতে যেনো সেঁধিয়ে যাচ্ছিলো। আরোহীদের চেহারায় যেনো ভয়ের চিহ্নই নেই। তাদের মুখে লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’র জিকির। যিনি নেতা গোছের মুরব্বি, তিনি ড্রাইভারকে অভয় দিয়ে গাড়ি থামাতে বললেন। ড্রাইভার বলতে চাচ্ছিলোÑ ওরা ভয়ংকর ডাকাত! লুটতরাজ ও মানুষ হত্যা ছাড়া ওদের অভিধানে অন্য কোনো শব্দ নেই। মুরব্বিরা ড্রাইভারের পিঠে হাত রেখে তাকে থামতে বললেনÑ ‘তুমি এখানেই থাকো, আমি দেখছি।’ একথা বলে মুখে মুচকি হাসি দিয়ে শুভ্র শ্মশ্র“মণ্ডিত নুরানি চেহারার লোকটি গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলেন রাস্তা ব্যারিকেড করে দাঁড়ানো ডাকাতদের কাছে। গাড়ির অন্য আরোহীদের বলে গেলেন লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’র জিকির বাড়াতে।
তিনি চেহারায় রাজ্যের প্রসন্নতা আর কন্ঠে মধুরতা এনে সালাম দিলেন ডাকাত ছোকড়াদের। অস্ত্রধারী ডাকাতদলের মুখোশপরা লোকটি থতমত খেলো। সালামের উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইলো অপলক। ক্ষণকাল নিরবতা। হঠাৎ বেজে উঠলো মুরব্বি লোকটির কন্ঠÑ ‘বাবারা! আমি তোমাদের সালাম দিয়েছি। সালামের উত্তর নেয়া ওয়াজিব। এটা নবীজি সা.-এর সুন্নত!’
তিনি বলে চলছেন, ‘একজন মুসলমানের সঙ্গে অপর মুসলমানের দেখা হলে আগে সালাম দিয়ে পরে কথা বলতে হবে।...’ মুরব্বি সালামের ফজিলত বলে চললেন। মুখোশপরা লোকটি সালামের উত্তর দিতেই মুরব্বি মুসাফাহর জন্য দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন। ডাকাতদলের অন্য লোকগুলো স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে! তাদের নীরবদৃষ্টি যেনো ওস্তাদকে ডেকে বলছে, কী হলো উস্তাদ! রাততো শেষ হয়ে আসছে। এদের নিয়ে এতো মাখা-মাখি করছেন কেনো! তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে সটকে পড়লেই কেল্লাফতে।
এদিকে গাড়িতে জিকিরের শব্দ আস্তে আস্তে বেড়েই চলছে। ড্রাইভার মুরব্বির দিকে পলকহীন তাকিয়ে; মুরব্বি লোকটি ডাকাতদলের সবার সাথে মুসাফাহ করছিলেন আর নাম জিজ্ঞেস করছিলেন। ওরা নিজেদের নামও বলছিলো। কি এক সম্মোহিতের মধ্যে যেনো ওরা সবাই। মুরব্বি সবাইকে লক্ষ করে বলতে শুরু করলেন, ‘বাবারা আমরা যা কিছু দেখি না দেখি সবই মাখলুক। মাখলুক কিছু করতে পারে না আল্লাহ্র হুকুম ছাড়া, আল্লাহ্ সবকিছু করতে পারেন মাখলুকের কথা ছাড়া।’
মুরব্বি শুরু করলেন হাদিসের আলোকে তার হৃদয়কাড়া জাদুকরি বয়ান। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছিলো বিবেক জাগানিয়া বয়ান, ভেতরে বদ্ধদরজায় আঘাত হানা সেসব কথামালা। যেগুলো শুধু কানেই যাচ্ছে না, মনে হয় ওদের হৃদয়ের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে কে যেনো।
হঠাৎ দলপতি মুরব্বিকে বললো বাবা, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
মুরব্বি বললেন, আমরা দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে বের হয়েছি। এখান থেকে দু’কিলোমিটার দুরে একটা শহর আছে না? মুখোশপরা লোকটি বললো, জি বাবা। হারিরাম উপজেলা সদর।
Ñওখানে একটি বড় মসজিদ রয়েছে। তাতেই আমরা উঠবো। বাবারা সেখানে পারলে এসো। মুখোশপরা লোকটি ঘাড় কাত করে দলের সদস্যদের বললো, এই তোরা রাস্তা ছাড়! মুরব্বিদের এতো রাতে এতোক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা উচিত হচ্ছে না। বড়ো বেয়াদবি হচ্ছে। তারা আল্লাহ্র ঘরের মেহমান। মুরব্বি ওদের সালাম দিয়ে গাড়িতে উঠলেন। ড্রাইভার বুকে ফুঁ দিয়ে গাড়ি ছাড়লো। তার বুক থেকেও যেনো ভারী একটা পাথর সরে গেলো। কারণ অনেক কষ্ট করে এই গাড়িটি সে কয়েকদিন আগে কিনেছে।
হরিরামপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। মসজিদে তাবলিগের সাথীরা সকালের নাস্তা সেরে তালিমে বসেছিলেন। একজন ফাজায়েলে আমল থেকে পড়ে যাচ্ছেন, অন্যরা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। এমন সময় ৫/৬ জন ছেলে আটপৌড়ে পাঞ্জাবি গায়ে মসজিদে ঢুকে কাকে যেনো খুঁজছে। তালিম শুনতে শুনতে হালকার কয়েকজন ইতিউতি করছিলো। তালিমের একপাশে ছিলেন আমির। হঠাৎ তার চোখে পড়লো সদ্য মসজিদে প্রবেশ করা ছেলেদের ওপর। সবাই একরকম দৌড়ে তার পাশে বসলো। মুরব্বি কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো ছেলেরা। প্রথমে হতভম্ব হয়ে রইলেন তিনি। তালিম থেমে গেলো। অন্য সাথীরাও অবাক। ছেলেগুলো কেঁদেই চললো। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে ফোঁপানো কান্নার সুরেই বলতে লাগলো, বাবা আমাদের মাফ করে দেন। আমাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ্ আমাদের মাফ করে দেন। আল্লাহ কি আমাদের মাফ করবেন না? আমরা কতো পাপ করেছি। কতো মানুষ মেরেছি। কতো মানুষের ধন সম্পদ লুট করেছি। আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য ক্ষমা চান। আমরা আর ডাকাতি করবো না। আপনাদের সঙ্গে দেখা না হলে আমাদের কী যে হতো! আমরা দীনের কাজ করবো। দীন শিখবো। দয়া করে আমাদের জন্য একটু দোয়া করুন।
মুরব্বি নিজের পা সরিয়ে ওদের পিঠে হাত বুলালেন। তার চোখ ফেটে অশ্র“ প্রবাহিত হচ্ছিলো। এ অশ্র“গুলো দুঃখের নয়। এটা প্রভুর অপার মেহেরবানির আনন্দাশ্র“। তার দুয়েকটি কথায় ডাকাতদলকে নিয়ে এসেছে মসজিদে। বদলে দিয়েছে তাদের পুরো জীবন।