Skip to main content

প্রধান রচনা



প্রিয় ভাই! পৃথিবী আপনাকে ডাকছে !!

লাবীব আব্দুল্লাহ



দেশের আনাচে কানাচে আজ গড়ে উঠেছে কওমী মাদরাসা। নূরানী মক্তব থেকে শুরু করে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত জামেয়ার সংখ্যা আজ আর হাতে গোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সারাবছর ঢিমেতালে সবক চললেও প্রায় সব মাদরাসায় সালানা কিংবা বার্ষিক পরীক্ষার আগে তাড়াহুড়ো করে সিলেবাস বা নেসাব শেষ করার প্রবণতা আমাদের অঙ্গনে রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 


প্রতিবছর বার্ষিক পরীক্ষার পর থেকে দুমাস বন্ধ থাকে মাদরাসার কিতাবখানাগুলো। শাওয়াল থেকে আবার নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু। এর মাঝামাঝি দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস দরস বন্ধ। জুমাবার যোগ করলে বছরের দীর্ঘ সময় কেটে যায় ছুটিতেই। পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ এ সময় দেয়া কতটুকু উচিৎ তা কওমি কর্তৃপক্ষকে ভেবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার সবিনয় অনুরোধ করছি। তালিবুল ইলমকে মাদরাসার কাহাফী পরিবেশ থেকে বাইরের অনিরাপদ পরিবেশে এভাবে ছেড়ে দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত- তাও ভেবে দেখার বিষয়। শুধু রমযানে অধিকাংশ মাদরাসার নাহু-সরফ কোর্স ছাড়া বিশেষ কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি নেই।


অধিকাংশ তালেবে ইলম রুটিনবিহীন সময় নষ্ট করে জীবনকে মূল্যহীন করছে। বেফাকের সিরিয়াল, মেধা তালিকায় স্থান প্রাপ্তির জন্য সব দৌড়ঝাঁপ। দরসি কিতাব কুতুবখানায় জমা দিয়ে তাইসীর ও তাসহীল নিয়ে ব্যস্ত। উর্দু-ফার্সিকে তালাক! ভুল বাংলায় পরীক্ষার প্রস্তুতি। মেধাহীন অনুবাদকের অনুবাদনির্ভর দরসী কিতাব পড়ে অযোগ্য এক প্রজন্ম বের হচ্ছে কওমি মাদরাসা থেকে। পরীক্ষার হলে আরবী ভাষায় উত্তরপত্র লেখার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। একদল অসাধু প্রকাশক তাসহীল ও তাইসীর নামের বিষ খাইয়ে জীবনহানী করছে তালেবে ইলমদের। আরবী শরাহ মুতাআলার আগ্রহ কমে যাচ্ছে দিনদিন। সবার টার্গেট বেফাক মেধা তালিকায় স্থানপ্রাপ্তি। মাদরাসাগুলোর ভালো-মন্দ বোঝার মাপকাঠি হলো মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া না পাওয়ার ওপর। সেটা হোক ৫০তম। কোনো কোনো মাদরাসায় শুরু হয়েছে কোচিংবাণিজ্য। বাজারে গাইড মাদরাসায় কোচিং করে এ প্রজন্মের তালিবে ইলম কতটা যোগ্য হয়ে ওঠবে তা মহাভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।


দেশজুড়ে কওমি বোর্ড প্রায় ১৮টি। এগুলোর কোনটি ব্যক্তিনির্ভর আবার কোনটি অঞ্চলনির্ভর। কোথাও বাংলা ভাষার স্থান নেই। কোথাও উর্দু-ফার্সির সঙ্গে দুশমনি ভাব। কোথাও আবার শুধু আরবীর গুরুত্ব দেখিয়ে ইংরেজির সঙ্গে দুশমনি। সর্বত্র এক হযবরল অবস্থা। এদেরকে গঠনমূলক সমালোচনা করাও যাবে না। কারণ লেখকের বিরুদ্ধে মিছিল বা ইসলামের দুশমন আখ্যা দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। উত্তরাঞ্চলীয় বোর্ড, দণিাঞ্চলীয় বোর্ড, ঢাকাকেন্দ্রিক বোর্ড, সিলেট কেন্দ্রিক বোর্ড, চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক বোর্ড, মোমেনশাহী কেন্দ্রিক বোর্ড, নানা নামে বোর্ডের ছড়াছড়ি। জামেয়া ও বোর্ডের আধিক্যে দেশের গোটা কওমি শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। কোন সিলেবাস পড়াবে অভিভাবকগণ- শর্ট কোর্স, লম্বা কোর্স, মক্কিকোর্স, মদনী কোর্স, পাঁচ বছরের কোর্স, ৭ বছরের কোর্স, ক্যাডেট মাদরাসা, এক বছরে মাওলানা বানানোর কোর্স- এতসব লোভনীয় ও মোহনীয় কোর্সের ভিড়ে দরসে নিজামীর অস্তিত্ব পাওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে প্রায়। সবাই দাবি করছেন, আমরা যুগোপযুগি, পৃথক-আলাদা ও ভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠান।


জামেয়া কোর্সের প্রবক্তরা কি দেওবন্দী চেতনা লালন করছেন? দারুল উলূম দেওবন্দের অনুসারী  হিসেবে পরিচয় দিয়ে এভাবে শর্ট কোর্সের নামে কওমি মাদারসার ঐতিহ্য ধংসের অধিকার কে দিলো? মহিলা মাদরাসাগুলোর কথা না-ই বা লিখলাম। কারণ ছেলেরা একযুগ বা দেড় যুগে হয় মাওলানা আর মহিলা মাদরাসার ছাত্রীরা হয় ছয় বছরে আলেমা। কিছুদিন পর আট বছর পড়লে তারা হবেন আল্লামা। কি বিচিত্র ব্যবস্থা।


আমাদের প্রথম সমস্যা হল, আমরা আত্মসমালোচনায় অভ্যস্ত নই। প্রতিদিন পত্র পত্রিকায়, মিডিয়ায় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ও অবনতি নিয়ে লেখা হচ্ছে। তারা আত্মসমালোচনা করে উন্নতি করছে। পক্ষান্তরে কওমি মাদরাসার গঠনমূলক কিছু প্রস্তাব দিলেও আমার কওমিপ্রেমিক ভাইয়েরা তাকে অঙ্গনের বাইরে মনে করেন। তার বিরুদ্ধে গোমরাহির ফাতওয়া দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে ভেতরে ও প্রকাশ্যে। এভাবে চলতে থাকলে কওমি মাদরাসার অবস্থা দেশের অবহেলিত মক্তবের মতো হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। এলোমোলো অবস্থা কেন হলো? এর জন্য দায়ী কে? কে ধ্বংস করছে কওমি মাদরাসা? এখানেও কি ইহুদি নাসারাদের ষড়যন্ত্র তথ্য তালাশ করা হবে?


সরকারের গঠিত কওমি মাদারাসা শিক্ষা কমিশনযদি একটি একক ও অভিন্ন সিলেবাস প্রণয়ন করে, যদি একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গবেষণামূলক পড়ালেখার  সুযোগসমৃদ্ধ একটি সিলেবাস উপহার দেয় তাহলে জাতি তাদেরকে কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করবে। দুআ করবে এ প্রজন্মের লাখো তোলাবায়ে ইলম। কিন্তু তেমন কোন আশার সূর্য কিংবা সুবহে সাদিক এখনও দেখা যাচ্ছে না।

সরকারের  সনদের স্বীকৃতির আশায় বসে না থেকে নিজেদের স্বার্থেই সুশৃঙ্খল, সময়োপযোগী একটি সিলেবাস প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সব বোর্ডের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এ কাজ করা উচিৎ। এমন এক অভিন্ন সিলেবাস থাকবে যা পূর্ণ করলে তাকে আলেম বা মাওলানা বলা হবে। যেমন কোরআন হিফয না করলে তাকে হাফেজ বলা হয় না। যারা সম্মিলিতভাবে প্রণিত সিলেবাস অনুসরণ করবে না তাদের তালিকা করে জাতীয়ভাবে প্রচার করা- এরা কওমী মাদরাসার চেতনাধারী কেউ নয়।  ঘোষণা করা হোক, এরা কওমী মাদরাসার ধ্বংসের জন্য কাজ করছে।


তালেবে ইলম ভাইদের উদ্দেশ্যে বিশেষ আবেদন, আপনারা সনদের স্বীকৃতির পেছনে পড়ে যাবেন না।  নিজেকে গড়ে তুলুন। যুগের দাবি অনুযায়ী গড়ে তুলুন। পূর্ণ দক্ষতার সঙ্গে আরবি শিখুন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষ হোন। নিজেদেও উদ্যোগে শিখুুন ইংরেজি ভাষাও। উর্দু ও ফার্সি ভাষাতেও পারদর্শিতা অর্জন করুন। তবে ভাষা শিখার নিয়ম মেনে। শিখুন ধাপে ধাপে। যুগ আপনাকে জানাবে স্বাগত। এ ঘুণেধরা সমাজে আপনি হবেন স্বীকৃত ও মাননীয় ব্যক্তিত্ব। আপনি খতিব হলে জাতি পাবে অনেক কিছুই। অপনি সুদক্ষ ও প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস, মুদাররিস হলে শিক্ষার্থীরা পিপাসা নিবারণ করবে আপনার ইলমি ঝর্ণাধারা থেকে। আপনি আধুনিক সমাজকে জানা বোঝার চেষ্টা করুন। পর্যবেক্ষণ করুন আপনার সময় ও কাল। সময়ের বহুমুখী দাবি, জাতি আজ হতাশ। বিশ্ব ক্রমাগত অস্থির, আধুনিক শিক্ষিতরা অনেক ক্ষেত্রেই আজ ব্যর্থ। 

দুর্নীতিতে ভাসমান আজকের আধুনিক সমাজ। প্রিয় দেশ প্লাবিত অনৈতিকতার ভয়াবহ বন্যায়। মানুষ ভেসে যাচ্ছে পাপের স্রোতে। আপনি এসব স্রোতে না ভেসে স্রোতের মোড় ঘুরিয়ে দিন। শন্তিময় দ্বীনের ভুবনজয়ী পতাকা আপনার হাতে। হতাশাগ্রস্ত পৃথিবী আপনার অপেক্ষায়। অপেক্ষায় শূন্য  অনেক সেক্টর আপনি সেগুলোর জন্য ফ্যাক্টর হোন। এ শূন্যতা আপনাকেই পূরণ করতে হবে। আপনার স্বীকৃতি আপনি দিন, সময় অপচয় না করে গড়ে তুলুন আপন ভুবন। আমলের ভুবন। বিচরণ করুন জ্ঞানের সুবিশাল রাজ্যে। শরিক হোন আকাবির-আছলাফের কাফেলায়, যাদের স্বীকৃতি ছিল বিশ্বের কাছে, তাদের যোগ্যতা বলেই। আপনিও নিজকে যোগ্য করে গড়ে তুলুন। পৃথিবী আপনাকে ডাকছে।

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।