Skip to main content

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতী আমিনী রহ. পরমপ্রিয় উস্তাদরুহানী পিতা;
কিছু কথা কিছু টুকরো স্মৃতি

-আনছারুল হক ইমরান

আমি এমন একজন মহান ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কলম ধরলাম। যার বিয়োগ ব্যাথায় কেঁদেছিল আকাশ, কেঁদেছিল দেশ-বিদেশের লাখো-কোটি মানুষ। যিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন ইসলাম ও দেশদ্রোহী সকল বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে। ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি ছিলেন অতন্ত্র প্রহরী। অস্ত্র ছিল তার ‘‘নারায়ে তাকবীরের স্লে­াগান, শেষ রাতে আপন প্রভুর দরবারে কান্নাকাটি।’’ তিনি আমার রুহানী পিতা, পরমপ্রিয় উস্তাদ, অন্ধকারে আলোর দিশারী, ধৈর্যের বাতিঘর, নিমোর্হের উজ্জল দৃষ্টান্ত আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ.। (আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)


আমার স্বপ্ন পুরুষ
১৯৯৬ সালের কথা। আমি গ্রামের হাফেজিয়া মাদরাসায় সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। কিছুদিন পরই মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল। আমার মরহুম আব্বাজান হাফেজ মাওলানা জুহুরুল হক রহ. বললেন এবার মাহফিলে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লালবাগ মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা মুফতী আমিনী তাশরিফ আনবেন, তিনি এর আগেও একবার এসেছিলেন। তখন তুমি অনেক ছোট ছিলে। আহ! কি অপূর্ব বয়ান তার!! এ কথাগুলো আমাকে মুফতী আমিনী রহ. এর ব্যাপারে আকৃষ্ট করেছিল। আমি আশায় থাকতাম। কখন আসবেন আমার স্বপ্নপুরুষ। আমার দিনগুলো যেন শেষই হতো না। সকল কল্পনা জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে একদিন উপস্থিত হলো সেই সুবর্ণ সুযোগ। তিনি আসলেন, বয়ান করলেন। আল্লাহু আকবার স্লোগানে মুখরিত হলো মাদরাসা-ই-নূরীয়া বিটঘরের প্রাঙ্গণ। আমিও সেদিন উজ্জীবিত হয়েছিলাম তার দরাজকণ্ঠের জ্বালাময়ী বয়ান শুনে। তারপর তিনি ঢাকায় ফিরে গেলেন।
আমি আব্বাকে বললাম, আমি লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হবো। তিনি বললেন, আগে হিফজ শেষ কর। তারপর সেখানে গিয়ে দাওর শোনাবে। তুমি ছোট মানুষ। ঢাকা শহরে একা থাকতে পারবে না। আমিও ছিলাম নাছোড়বান্দা। আম্মুকে গিয়ে বললাম, আমি লালবাগ মাদরাসা ছাড়া অন্য কোথাও পড়ব না। তিনি অনেক কষ্টে আব্বাজানকে রাজি করালেন। আমি লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হলাম। এখানে এসে একটি বিষয় দারুণভাবে আমার হৃদয়ে নাড়া দিল- মুফতী আমিনী রহ. প্রতি বৃহস্পতিবারে শেষরাতে সব ছাত্রদের নিয়ে আল্লাহর দরবারে তাহাজ্জুদ পড়ে দুআ করতেন। আহ! কি যে কান্না! ফিরায়া দিয়ো না, ফিরায়া দিয়ো না! বলে তিনি বাচ্চাদের মতো হাউমাউ কাঁদতেন। মসজিদজুড়ে শুধুই কান্নার রোল।
ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন
২০০১ সাল। আমি তখন মিযান জামাতে পড়ি। বাংলাদেশের হাইকোর্ট থেকে দুজন বিচারপতি রায় ঘোষণা করলেন, সবধরণের ফতোয়া অবৈধ।’’ এ দুজন বিচারপতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন বাতিলের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিদ্রোহ, বাংলার সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী, মর্দে মুজাহিদ আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ.। কোন কিছুকে তোয়াক্কা না করে তিনি  মুরতাদ ঘোষণা করলেন এ দু বিচারপতিকে। দেশব্যাপী দিনরাত সফর করে ফতোয়ার পক্ষে সৃষ্টি করলেন গণজোয়ার। শায়খুল হাদীস, চরমোনইয়ের মরহুম পীর মাওলানা ফজলুল করীম রহ., পটিয়ার আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রহ., আল্লামা আহমদ শফী দা.বা., নুরুদ্দীন গওহরপুরী রহ.সহ সব আলেম ঐক্যবদ্ধ হলেন। ২রা ফেব্রয়ারীর পল্টনের ঐতিহাসিক মহা সমাবেশ থেকে মুফতী আমিনী রহ. ৩রা ফেব্রয়ারী দেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করলেন। আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ, ধর্মপ্রাণ মুসলমান সবাই ফতোয়া রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হরতালে গাড়ি ভাংচুর ও পুলিশ হত্যা মামলায় গ্রেফতার হলেন তারা দুজন- মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ.। বি-বাড়ীয়ায় ৬ জন শাহাদাত বরণ করলেন। এসব কিছু আমাকে মুফতী আমিনীর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। আমি সুযোগ খুঁজতাম কীভাবে হুজুরের খেদমত করা যায়। যেখানেই হুজুর বয়ান করতেন, পাগলের মত ছুটে যেতাম।
যেভাবে পরিচয়:
২০০৫ সালের কথা। হুজুর যাবেন আমাদের পাশের গ্রাম বিদ্যাকুট মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে। কিভাবে তার সফরসঙ্গী হওয়া যায়। যোগাযোগ করলাম হুজুরের ব্যক্তিগত সহকারী আলতাফ ভাইয়ের সাথে। তিনি সানন্দে আমাদের সফরে সাথী হওয়ার ব্যবস্থা করলেন। হুজুর বি-বাড়ীয়া সার্কিট হাউসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য উঠলেন। অনেক ছাত্রই সেখানে উপস্থিত ছিল। হঠাৎ করেই হুজুর আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন তর নাম কি রে? আমি বললাম-ইমরান। কোন জামাতে পড়স? বললাম- শরহেজামী। আগামী কাল থেকে আমার কোটগুলো লন্ড্রিতে নিয়ে যাবি। ঠিক আছে? বললাম- ইনশাআল্লাহ। আমি আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করলাম। এতবড় একজন উচুঁ মাপের মানুষের খেদমত করার সুযোগ পাওয়াটা আমার জন্য ছিল সত্যিই সৌভাগ্যের। তারপর থেকে তো দেশব্যাপী বিভিন্ন সফরে তিনি আমাকে সাথে রাখতেন। যখন গাড়ীতে থাকতেন, সারাক্ষণ শুধু মুতাআলা করতেন। একটু পর পর বলতেন- পান দাও। কখনো বা নিজের সমসাময়িক কোন রাজনীতিবিদদের সাথে কথা বলতেন। তবে আমি তাকে কোনদিন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কথা বলতে দেখিনি।
পড়ালেখা ছিল তার নিত্যসাথী
২০০৭ সালে একবার হুজুর ব্রেইন স্ট্রোক করলেন। ইবনে সিনা হাসপাতালে হুজুরের খেদমত করছিলাম আমি। হঠাৎ দেখলাম, তিনি বিছানার আশপাশে হাত বাড়িয়ে কি যেন খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করলাম- কি খুঁজছেন? কোন কথা বললেন না। শুধু বললেন- কিতাব। চোখে সমস্যা ছিল। মুখের ভাষাও ছিল অস্পষ্ট। ডাক্তাররা তাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য কয়েকটি ইনজেকশন দিলেন। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছিল না। হুজুরের ছোট ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী ও মেয়ে জামাই মাওলানা সাখাওয়াত সারারাত আপ্রাণ চেষ্টা করলেন ঘুম পাড়াতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলেন। তিনি শুধু হাত বুলাচ্ছিলেন দেয়ালে। আর মুখে ছিল একটি আওয়াজ- কিতাব, কিতাব।  কিতাব পড়ার জন্য তার এই ব্যাকুলতা সত্যিই আমাকে সেদিন আশ্চর্য করেছিল। এই অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি হাসপাতালের বেডে বসে খাতায় নোট করতেন। ওটা ছিল তিলাওয়াতে কুরআন বইয়ের পাণ্ডুলিপি। যা পরে উর্দু ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল।
বায়আত গ্রহণ:
২০০৮ সাল। বুখারী সবক শেষে হুজুর দেশের কল্যাণ কামনা করে আমাদেরকে নিয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতেন। আমরা কয়েকজন হুজুরের কাছে বায়আত গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলাম। কারণ, আমরা জানতাম তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. ও আল্লামা আহমদ শফী দা.বা থেকে বায়আত করার ইজাযত প্রাপ্ত। হুজুর প্রথমে বায়আত করতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু আমাদের আগ্রহ দেখে বললেন, তোমাদের মধ্যে যারা কমপক্ষে একাধারে ১০দিন নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়বে। আমি শুধু তাদেরই বায়আত করব। শুরু হল ছাত্রদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কে কার আগে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ পড়বে। অবশেষে তাকমীল জামাতের অধিকাংশ ছাত্রই হুজুরের কাছে বায়আত হয়ে তৃপ্ত হল। হুজুর ঘোষণা করলেন- প্রতিমাসে একটি করে ইসলাহী জলসা হবে। আমাকে দায়িত্ব দিলেন সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য। মৃত্যু অবধি তিনি এটা জারি রেখেছিলেন। আমাদের তিনি শুধু একটিই নসীহত করতেন, দেখ! রুহানিয়্যাত ছাড়া কোন কোন কাজে সফলতা লাভ করা যায় না। ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হতে হলে সবার আগে দরকার রুহানিয়্যাত বা আত্মার পরিশুদ্ধি।’’ আরও বলতেন, আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন ছাড়া শুধুমাত্র জাহেরী ইলম দ্বারা বর্তমানে টিকে থাকা মুশকিল। এটাই ছিল আমাদের পূর্বসূরী আকাবিরদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি আরও বলতেন, শুধু সংগঠন দিয়ে নয়, বিপ্লব হয় আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে।’’ এ জন্য বারবার মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহ. এর কথা উল্লেখ করতেন এবং দ্বীনে এলাহী ও হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর সংস্কার নামে একটি বইও রচনা করেন।
নিঃস্বার্থ পরোপকারী
২০০৮ সালে তাকমীল শেষ করে আমি চলে গেলাম। সামনে ছিল দাখিল পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা ফিরলাম। বখশী বাজারে মাসিক নব্বধনির অফিসে থাকতাম সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। হুজুর প্রায় সময়ই ইফতার সবকে আমাকে খুজতেন। কিন্তু যেহেতু থাকতাম বখশী বাজারে তাই অনেক সময় উপস্থিত হতে পারতাম না। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- কি ব্যাপার? তরে ঠিকমত পাওয়া যায় না। কই থাকস?  বললাম, বখশী বাজার। তিনি প্রশ্ন করলেন, ইফতায় ভর্তি হস নাই? বললাম, জ্বি না। অর্থকষ্টের কথা না বললেও আমার চেহারা দেখে বুঝে ফেললেন। হুজুর বললেন, আগামীকাল দুপুরে আমার সাথে দেখা করিস।
পরদিন দুপুরে কোন একজন থেকে ধার করে আমাকে ২০০০ টাকা দিয়ে বললেন, যা তর ভর্তির কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। মাওলানা ইসহাকের (জামেয়া উস্তাদ) কাছে ভর্তির টাকা জমা দিবি। আর বাকী টাকা দিয়া লালবাগ মাদরাসার বোর্ডিংয়ে খানা জারি করবি। আলতাফ ভাইকে বললেন, তর থাকার রুমটা ইমরানরে দিয়া দে। এভাবে তিনি আমার সব মৌলিক সমস্যার সমাধান করে দিলেন। আমার মতো অধমের জন্য তার এমন মহানুভবতা ও মায়া দেখে আমি সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আর এমনিভাবে তিনি আমার কতো যে উপকার করেছেন, তা কখনো ভুলা যাবে না।
উৎসাহের বাতিঘর
আমি জানতাম হুজুর আলিয়া মাদরাসায় পরীক্ষা দেওয়াকে ভাল দৃষ্টিতে দেখতেন না। এর অবশ্য কারণও আছে। একবার আমি ভয়ে ভয়ে গিয়ে বললাম- হুজুর! আমি তো আপনাকে না জানিয়ে একটি কাজ করে ফেলেছি। হুজুর বললেন, কী? বললাম, দাখিল পরীক্ষা দিয়েছি। হুজুর মুচকী হাসি দিয়ে বললেন, ফারেগের আগে না পরে? বললাম, পরে। বললেন, সমস্যা নাই তবে মনে রাখবি, নিজের আকিদা, বিশ্বাস, লেবাস, সুরত ঠিক রাইখা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াটা দোষের না। গত ৪ এপ্রিল-১২ হরতালের পরদিন ৫ এপ্রিল ছিল আমার আলিম পরীক্ষা। হরতালের দুদিন আগে তাকে জানালাম বিষয়টা। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। যদিও অনেকে আমাকে সেদিন ভুল বুঝেছিল। ফলাফল প্রকাশের পর চিন্তা করলাম, আইন বিষয়ে পড়বো। দ্বীন ও ইসলামের পক্ষে আদালতে লড়তে হলে আমাকে এ বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। হুজুরকে বললাম, আমি আইন বিষয়ে পড়লে কেমন হয়? তিনি বললেন, না, সেখানে গিয়ে তুই ঠিক থাকতে পারবি না। মিথ্যাচার, ঘুষ কারবারীতে ঢাকা পড়ে গেছে আইন, আদালত। তুই ইংরেজি পড়। এটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। তার পরামর্শ মতো আমি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ২০১১-১২ সেশনে ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হলাম। কিন্তু আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। আর কেউ আমাকে এভাবে উৎসাহ দিবে না । আর কেউ বলবেনা, তুই এটা কর, ওটা কর।
তাঁর সাথে আমার শেষ কথা
গত ১১ ডিসেম্বর-১২ মঙ্গলবার বাদ জোহর লালবাগ মাদরাসার উস্তাদ আবু বকর ভাইকে বললাম, চলেন! হুজুরের কাছে যাই। ইসলাহী জলসার তারিখটা ঠিক করে আসি। সালাম দিয়ে তার রুমে প্রবেশ করলাম। তিনি বললেন, কি ব্যাপার? বললাম, এই মাসের ইসলাহী জলসা তারিখটা ঠিক করতে এসেছি। তিনি হেসে বললেন, ও আইচ্ছা! তো কবে করলে ভাল হয়?  আবু বকর ভাই বললেন, আগামী বৃহস্পতিবার। হুজুর বললেন- না, ঐ দিন তো হরতাল। তোমরা বরং ২০ ডিসেম্বর পরের বৃহস্পতিবার কর। আর সবাইকে দাওয়াতটা পৌঁছাইয়া দেও। আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব। তার কথামতো আমি দাওয়াতনামা তৈরি করে মাদরাসায় ফিরলাম। বাদ এশা মাদরাসার দফতরে বসে মাওলানা সাখাওয়াত সাহেবের সাথে আলাপ করছিলাম। এমন সময় হুজুর কলিংবেল টিপলেন, অফিসে কেউ না থাকায় আমি ভিতরে গেলাম। জিজ্ঞেস করলেন, সোহেল, মাসুদ- ওরা কোথায়? কোন সদুত্তর দিতে না পারায় স্বভাবসূলভ আমাকে ধমক দিলেন- জলদি দেখ, ওরা কোথায় আছে? এটাই ছিলো আমার রুহানী পিতা, আধ্যাত্মিক রাহবার, আত্মার আত্মীয়, পরমপ্রিয় শ্রদ্ধেয় উস্তাদ আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. এর সাথে আমার শেষ কথা।
তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে
রাত সাড়ে এগারটার দিকে রুমে বসে পড়ছিলাম। এমন সময় জামেয়ার ছাত্র আব্দুর রহমান ফোন করলো। ইমরান ভাই! আপনি কোথায়? আমিনী সাহেব অসুস্থ। তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সব ছাত্ররা যাচ্ছে। চিন্তা করলাম, এখন না, সকালে যাব। কিন্তু আবার চিন্তা করলাম সব ছাত্র যাবে কেন? কি এমন অসুখ! নিশ্চয় মারাত্মক কিছু! সময় নষ্ট না করে আব্দুর রহমানকে নিয়ে ছুটে গেলাম হাসপাতালে। দেখলাম জামেয়ার উস্তাদ, ছাত্র, দলীয় কর্মী সবাই চিন্তিত মনে বসে আছে। তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে আসলেন, জামেয়ার সিনিয়র উস্তাদদের কানে কানে কি যেন বললেন। সবার চোখে অশ্রজল। তখনও আমি বুঝতে পারিনি আমার রুহানী পিতা ইহজগতে আর নেই। একটু পর হুজুরের মেয়ে জামাই ও আমার উস্তাদ মাওলানা জসিম উদ্দিন সাহেব ছেলে মাহদীকে বললেন- মাদরাসায় চলে যাও। লাশ নিয়ে আসছি। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। কোন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে নিচে নেমে একটা রিক্সা করে সোজা লালবাগ চলে এলাম। বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর ফোন আসছিল, হুজুরের কি অবস্থা? মিডিয়ায় হুজুরের মৃত্যু সংবাদ প্রচার হচ্ছিল। অনেকে আমাকে ফোন করে এবিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইল। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারিনি। রাত ১টার সময় হুজুরের মরদেহ তাঁর স্মৃতি বিজড়িত দরসগাহ্ ে(যেখানে বসে তিনি দরাজ কণ্ঠে বুখারী শরীফের দরস দিতেন) আনা হলো। প্রিয় ছাত্র, ভক্ত-মুরিদ, শুভাকাঙ্খীরা সারিবদ্ধ হয়ে তার নুরানী চেহারা দেখলো। কিন্তু আমার সাহস হয়নি তার লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। অনেক জোর করে এক বন্ধু পরদিন আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেও আমি তাকাতে পারিনি আমার রুহানী পিতা, পরম উস্তাদের নুরানী চেহারার দিকে। আমি চেয়েছি, জীবিত মুফতী আমিনী রহ.-এর হাসিমাখা মুখায়বটিই যেন অবশিষ্ঠ থাকে আমার হৃদয়পটে। এক প্রবাসী বন্ধু সে দিন ফোন করে জানতে চাইল- ইমরান ভাই। আপনি আমিনী সাহেবের খুব কাছের মানুষ। কিন্তু মিডিয়ায় জানাজার ভিডিও ফুটেজে আপনাকে ছাড়া অনেককেই তো দেখলাম। কোথায় ছিলেন আপনি? আমি এর কোন সদুত্তর দিতে পারিনি।
তবুও তিনি আছেন
একটি অপ্রিয় সত্যি কথা। অনেকেই হয়তো বা ভুল বুঝতে পারেন। আপন জন্মদাতা বাবার বিয়োগব্যাথায়ও এত কষ্ট আমি পায়নি- যা পেয়েছিলাম তাঁকে হারিয়ে। মুফতী আমিনী রহ. আমার জন্মদাতা পিতা নন- কিন্তু তিনি আমাকে মানুষ বানাতে অক্লান্ত চেষ্টা করেছেন। আমার ক্ষুদ্র জীবনের যা কিছু অর্জন সবই পেয়েছি তাঁর কল্যাণে। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, একথা আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। আমি মনে করি, তিনি আছেন, থাকবেন, হাজারো, ভক্ত, মুরিদ, শুভাকাঙ্খীদের হৃদয়ের মনিকোঠায়।

Popular posts from this blog

মার্চ ২০১৪

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয় , আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে ; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতা Ñ এ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি , ‘ পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন ’ । শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান , আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে , বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক , আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক , কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।

মুফতী আমিনী রহ. স্মরণ সংখ্যা-২০১৩

মুফতি আমিনী- ভাঙা ভাঙা স্বরে সোনা ঝরানো কথা আর শুনবো না! - ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী এক. মুফতি ফজলুল হক আমিনী। এখন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। বুঝি নি , এতো তাড়াতাড়ি .. এতো অসময়ে .. এতো দুঃসময়ে হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন! সেদিন রাতে এতোটা ‘ ঘুম-কাতুরে ’ না হলেও পারতাম! গভীর রাতে অনেক ফোন এসেছে , ধরতে পারি নি! সময় মতো তাঁর মৃত্যু সংবাদটা জানতে পারি নি! ফজরে উঠে দেখি ; অনেক মিসকল। সাথে একটা ‘ মোবাইলবার্তা ’ Ñ ‘ মুফতি আমিনী আর নেই ’ ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! শোক-বিহ্বলতায় আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! শোকস্তব্ধ এতিমের মতো হাহাকার করতে লাগলো ‘ এতিম ’ মনটা! তাঁকে এভাবে হঠাৎ করে হারানোর শোক অনেক বড় শোক! কেননা , এ শোক প্রিয় উস্তায হারানোর শোক!

ইন্তেকাল

চলে গেলেন নিভৃতচারী আধ্যাত্মিক মনীষী   মুহাদ্দিস আল্লামা   নুরুল ইসলাম জদীদ (রহ.) হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর একে একে আমাদের মুরব্বীগণ বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন জাতির অকৃত্রিম অভিভাবক ,   জাতীয় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক রহ. ,   খতিব মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ,   সাবেক এমপি মাওলানা আতাউর রহমান খান ,   মুফতিয়ে আযম মাওলানা আহমদুল হক (রহ.) ,   পীরে কামিল মাওলানা জমির উদ্দিন নানুপুরী (রহ.) ,   কুতুবে যামান মাওলানা মুফতি আজিজুল হক (রহ.) এর সুযোগ্য খলিফা মাওলানা নুরুল ইসলাম (কদিম সাহেব হুজুর) (রহ.) ,   প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব (রহ.) ,   শায়খুল হাদীছ মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) এর মতো বরেণ্য ওলামা-মশায়েখ।